রাজধানীতে অতিরিক্ত যানবাহন ও ট্রাফিক অব্যবস্থাপনার কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে যানজট। এই যানজট নিরসনে গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সিগন্যাল বাতিতে ব্যয় করা হয়েছে ২০০ কোটি টাকা। কিন্তু এসব সিগন্যাল বাতির কোনো হদিস নেই। ফলে ম্যানুয়ালি চলছে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম।
সরেজমিন দেখা যায়, কাকরাইল, বাংলামটর, পল্টন, সায়েন্স ল্যাব, আজিমপুর, ফার্মগেটসহ রাজধানীর গুরত্বর্পূণ পয়েন্টে শত কোটি টাকার সিগন্যাল বাতির কোনো অস্তিত্বই নেই।
তথ্যমতে, রাজধানীর সড়কে ট্রাফিক সামলাতে সিগন্যাল বাতির ব্যবহার শুরু হয় ২০০১ সালে। ওই বছর ৭০টি ইন্টারসেকশনে ৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল স্থাপন করা হয়। এসব সিগন্যাল বাতি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এক বছরের মধ্যেই লাপাত্তা হয়ে যায়। পরে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১১০টি পয়েন্টে সিগন্যাল বাতি বসানোর জন্য ব্যয় হয় ২০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় ২০১২ সালে ‘ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট’ (কেস) প্রকল্পের আওতায় ২৯টি ইন্টারসেকশন করা হয়, যার ব্যয় দেখানো হয় ১১২ কোটি টাকা। পাশাপাশি প্রায় ২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে রিমোট ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ আমদানি করা হয়। ২০১৬ সালের শুরুতে চারটি ইন্টারসেকশন স্থাপনের জন্য ব্যয় ধরা হয় ৩৭ কোটি টাকা। পরে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৫২ কোটি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আওয়ামী সরকার রাজধানীর ৪৩টি ট্রাফিক সিগন্যাল সচল করতে কেস প্রকল্পের আওতায় উদ্যোগ নেয়, যা শেষ হয় ২০২০ সালের মার্চে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, সিগন্যাল লাইট নিয়ে শুরু থেকেই সিটি করপোরেশন ও পুলিশের মধ্যে টানাপড়েন ছিল। সিটি করপোরেশন প্রকল্প নিতে আগ্রহী হলেও সিগন্যাল লাইট নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। ফলে কোটি কোটি টাকা খরচ করে সিগন্যাল লাইট স্থাপন করা হলেও সে উদ্যোগ সফল হয়নি। যে কারণে এক পর্যায়ে বিশেষজ্ঞরা ২০১৯ সালের শুরুর দিকে ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা পুলিশের তত্ত্বাবধানে দেয়ার প্রস্তাব পাঠায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। প্রস্তাবটি অনেক দূর এগিয়েও ছিল। পরে প্রস্তাবটি পর্যালোচনা পর্যায়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন আতিকুল ইসলাম। তিনি ওই উদ্যোগ বন্ধ করে দেন। কিন্তু দায়িত্বটি সিটি করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণেই থেকে যায়। এছাড়া মেয়র আতিকুলের প্রভাবের কারণে সিগন্যাল ব্যবস্থা আর সফল হয়নি।
বর্তমানে ট্রাফিক জট কমাতে রাজধানীর ২২টি মোড়ে স্থানীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার। এ প্রযুক্তি তৈরি করেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। প্রকল্পটি শিক্ষা ভবন সংলগ্ন মোড় থেকে ফার্মগেট-মহাখালী হয়ে উত্তরা-আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত স্থাপনের কথা রয়েছে। এই প্রকল্পে শত কোটি টাকার বিলাসী ব্যয় না করে ব্যয় ধরা হয়েছে মাত্র ১০ কোটি টাকা।
প্রকল্পটির সঙ্গে জড়িত পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, ট্রাফিক জট কমাতে রাজধানীর ২২টি মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্র্বর্তী সরকার। বুয়েট এসব বাতি দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি করছে। কারণ অতীতে আমরা দেখেছি, ইউরোপ কিংবা অন্যান্য দেশের উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করেও সুফল আসেনি।
তিনি আরো জানান, আমাদের দেশের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাসহ সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়েরই উন্নত দেশের প্রযুক্তির সঙ্গে মিল নেই। এবার দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। এই প্রযুক্তি যানজট নিরসনে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ সফল হবে।
ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের ডেপুটি ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানার ধ্রুব আলম জানান, আমরা সিগনালের সমন্বয় নিয়ে কাজ করে থাকি। তবে পুরো বিষয়টি সিটি করপোরেশন দেখভাল করে। ফলে সিটি করপোরেশন চাইলে বিষয়টি ট্রাফিকের নিয়ন্ত্রণে দিতে পারে।
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) খোন্দকার নজমুল হাসান জানান, যানজট নিরসনে সিগনাল বাতি স্থাপন অতি জরুরি। বিগত সময়ে যেসব সিগনাল বাতি স্থাপন করা হয়েছে, তা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে সুফল আনেনি। তবে নতুন করে সিগনাল বাতি স্থাপন সুফল আনবে বলে আমরা আশাবাদী।
উত্তর সিটি করপোরেশন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাসুদ আলম ছিদ্দিক জানান, বিগত সময়ে সিগনাল বাতি স্থাপনে কত টাকা খরচ হয়েছে, সেই বিষয়ে আমি অবগত নই। তবে রাজনৈতিক কারণে অনেক সময় কর্মকর্তারা চাইলেও তাদের দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে পারেননি।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ বশিরুল হক ভূঁঞা জানান, আগে সিগনাল বাতি স্থাপনে প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে সুফল আসেনি। ফলে বাতিগুলো ব্যবহার না করার কারণে নষ্ট হয়ে গেছে।