Jaijaidin

অবৈধভাবে এসি ও রেফৃজারেটরের নিম্নমানের গ্যাস আমদানি

Shah Alam Soulav
6 Min Read

গাফফার খান চৌধুরী

এয়ার কন্ডিশনার (এসি) ও রেফৃজারেটরের কম্প্রেসারে ব্যবহারের জন্য বেআইনিভাবে নিম্নমানের বিপুল পরিমাণ গ্যাস আমদানি করেছে কয়েকটি কম্পানি। বিস্ফোরক পরিদপ্তর ও পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়াই আমদানি করা হয়েছে এসব গ্যাস। এমনকি আমদানির পর সংস্থা দুটির তরফ থেকে ন্যূনতম যাচাই-বাছাইও করা হয়নি। এতে সরকার যেমন বড় ধরনের রাজস্ব হারিয়েছে, সেই সঙ্গে এসি ও রেফৃজারেটরে এ গ্যাস ব্যবহার করা হলে বড় ধরনের দুর্ঘটনায় হতাহতের আশঙ্কা রয়েছে।

কাস্টমস গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, গত ২০ এপৃল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের রপ্তানি উন্নয়ন বুুরোর সচিব তরফদার সোহেল রহমান একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। তিনি মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ রেফৃজারেশন এন্ড এয়ারকন্ডিশনিং মার্চেন্টস এসোসিয়েশনের (ব্রামা) প্রশাসক হিসেবে দায়িত্বরত। তিনি কাস্টমস গোয়েন্দা মহাপরিচালক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর অভিযোগটি করেন। অভিযোগে বলা হয়েছে, মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে বেআইনিভাবে এসি আমদানিকারক এবং এর সঙ্গে জড়িত সিএন্ডএফ প্রতিষ্ঠানগুলো এসি ও রেফৃজারেটরের নিম্নমানের গ্যাস আমদানি করেছে। আমদানিকারকদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পরিবেশ অধিদপ্তর ও কাস্টমস বিভাগকে অনুরোধ জানানো হয়েছে আবেদনে।

এতে বলা হয়েছে, চলতি বছরের ১২ এপৃল পরিবেশ অধিদপ্তর ২০২৫ সালের জন্য এইচএফসি (হাইড্রোক্লোরোস ফ্লোরো কার্বন) কোটার অনুকূলে রেফৃজারেটরের গ্যাস আমদানির লাইসেন্স অনুমোদন করে। এদিকে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স অনুমোদনের আগেই বেআইনিভাবে রেফৃজারেটরের কম্প্রেসারে ব্যবহারের জন্য নিম্নমানের গ্যাস আমদানি করে এবং বন্দর থেকে খালাস করে তাদের হেফাজতে নিয়ে যায়। বেআইনিভাবে আমদানি করা রেফৃজারেটরের আরো অনেক নিম্নমানের গ্যাস খালাসের অপেক্ষায় চট্টগ্রাম বন্দরের কন্টেইনারে আছে।

চিঠিতে সচিব আরো বলেন, সিএন্ডএফ এজেন্ট কর্তৃক রেফৃজারেটরের পণ্য খালাসের নথিপত্রের সঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি পাওয়া প্রতিটি রেফৃজারেটরের আমদানি লাইসেন্সের কপি জমা দেয়া বাধ্যতামূলক। কারণ তাতে আমদানি করা রেফৃজারেটরের ধরন, অনুমোদনের পরিমাণ ও আমদানির মেয়াদকাল উল্লেখ থাকে। যেখানে লাইসেন্সের অনুমোদনই করা হয়নি, সেখানে এক্সামিনারসহ কাস্টমস কর্তৃপক্ষ কোন প্রক্রিয়ায় শতভাগ এক্সামিনের মাধ্যমে পণ্য ডেলিভারি করেছে? সেটি একটি বিরাট প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় এবং বেআইনিভাবে করা হয়েছে বলে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য মোতাবেক, এ ধরনের গ্যাস আমদানির জন্য ৪৩০টি আবেদন জমা পড়েছিল। তার মধ্যে যাচাই-বাছাই শেষে গত ১২ এপৃল পরিবেশ অধিদপ্তর ৩০৮টি প্রতিষ্ঠানকে গ্যাস আমদানির লাইসেন্স দেয়। এর মধ্যে অবৈধভাবে পরিমাণের তুলনায় অনেকগুণ বেশি গ্যাস আমদানি করে কিছু কম্পানি। এর মধ্যে অনুমোদন ছাড়াই রাফি এন্টারপ্রাইজের (যার কাস্টমস ইনভয়েস নম্বর এসডাবলি¬উ-৬২৩২৫০১৪৫) মালামাল ‘শতভাগ পরীক্ষণ পূর্বক’ রিলিজ করেন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সাইফুল করিম। এতে নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কোনো অনুমোদন নেই। এসব গ্যাস ব্যবহৃত হলে পরিবেশের জন্য ভয়াবহ হুমকির কারণ হতে পারে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, একটি প্রতিষ্ঠানকে আর-৪০সি গ্যাস ১ হাজার ২৪৪ দশমিক ২০ কেজি আমদানির অনুমোদন দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। কিন্তু ওই কম্পানি অবৈধভাবে আমদানি করেছে ৬ হাজার ৭৯৮ কেজি গ্যাস। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ডাটা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২৩০ দশমিক ২০ টন গ্যাস খালাসের জন্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু চারটি কম্পানি ৪৬ দশমিক ৮০ টন গ্যাস কাস্টমস বিভাগ থেকে ছাড় করিয়ে তাদের গোডাউনে সংরক্ষণ করেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অবৈধভাবে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার গ্যাস আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আছে রাফি এন্টারপ্রাইজ, সুপৃম এয়ারকন্ডিশনিং কম্পানি, মাসুম ট্রেডার্স, বিজয় ট্রেডার্স, বিসমিল্লাহ রেফৃজারেশন, মেসার্স তালুকদার ট্রেড সেন্টার, ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রিজ, আজিজ ট্রেড এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড, মেসার্স নাবিল ট্রেড কর্পরেশনসহ আরো বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।

বেশিরভাগ গ্যাসসহ অন্যান্য মাল কাস্টমস থেকে অবৈধভাবে ছাড় করানোর কাজটি করেছে সিএন্ডএফ এজেন্ট তাজ এজেন্সিজ। এর অফিস চট্টগ্রামের মুজিব রোডের ১৫১ সুলতান সুপার মার্কেটে। এ ব্যাপারে বারবার চেষ্টা করেও তাজ এজেন্সির কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এসি ও রেফৃজারেটরের কম্প্রেসার বিস্ফোরণে হতাহতের বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক ড. মাকসুদ হেলালী যায়যায়দিনকে বলেন, এসির দুটি পার্ট থাকে। একটি বাইরে। যেটিকে এসির আউটডোর বলা হয়ে থাকে। আরেকটি ভেতরের দিকে থাকে। যেটিকে ইনডোর বলা হয়। দুটিতেই কম্প্রেসার থাকে। এই কম্প্রেসার একেকটি একেক কাজ করে। কম্প্রেসারে থাকা লিকুইড গ্যাস দুটি আকার ধারণ করে। আউটডোরের কম্প্রেসারে থাকা গ্যাস ভেতর থেকে তাপ বের করে দেয়। আর ভেতরের কম্প্রেসারে থাকা গ্যাস বাইরের গরম বাতাসকে ঠান্ডা করে।

তিনি আরো বলেন, বাজারে অনেক ধরনের এসি ও রেফৃজারেটরের কম্প্রেসারে ব্যবহারের জন্য গ্যাস পাওয়া যায়। আগে যেসব গ্যাস এসি বা রেফৃজারেটরের কম্প্রেসারে ব্যবহৃত হতো, সেসব গ্যাসের কারণে আগুন ধরত না। এসব গ্যাস পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ছিল। তাই আন্তর্জাতিকভাবে আইন করে এসব গ্যাসের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো।

বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মাকসুদ হেলালী বলেন, আধুনিক যুগে যেসব এসি ও রেফৃজারেটর এসেছে এবং এসব ব্যবহার্য জিনিসপত্রে যে ধরনের গ্যাস ব্যবহৃত হচ্ছে, তাতে আগুন লাগে। তবে এসব গ্যাস পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয়। আন্তর্জাতিকভাবে এ ধরনের গ্যাস ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে। তবে বেশ কিছু নিয়মকানুন মেনে এ ধরনের গ্যাস ব্যবহার করতে হয়। এসব ব্যবহার করার পরও এসি বা রেফৃজারেটরের কম্প্রেসার বিস্ফোরিত হবে না বা আগুন লাগবে না এজন্য বেশ কিছু মেকানিক্যাল কার্যক্রম বা প্রযুক্তি যুক্ত করতে হয়। বাংলাদেশে এসি বা রেফৃজারেটর কেনার পর তা সঠিকভাবে মেইনটেইন করা হয় না। অন্যান্য প্রযুক্তিগত যন্ত্রপাতি যুক্ত করা তো পরের কথা।

তার মতে, এসব জিনিসপত্র বিকল হলে সঠিকভাবে মেরামত করার মতো দক্ষ কারিগরের অভাব রয়েছে। সঠিক গ্যাস ব্যবহার না করা ও সময়মতো সার্ভিসিং না করাসহ নানা কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। এমনকি প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটে থাকে।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *