যাযাদি রিপোর্ট
জুলাই বিপ্লবের শহীদদের হত্যার বিচার দাবি করেছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা। জুলাই হত্যাকান্ডের বিচারে ধীরগতি নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন তারা। জুলাই-আগস্টে উত্তাল দিনগুলোতে যারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে আহত হয়েছেন, সেই সাহসী বিপ্লবীদের সামনে আজ অনিশ্চিত জীবন। তাদের কথা কেউ ভাবছে না।
রোববার যায়যায়দিন মিডিয়াপ্লেক্সের ‘খালেদা জিয়া’ হলে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার কর্তৃক খুন,গুম ও কারানির্যাতনের শিকার পরিবারের সম্মানে দোয়া ইফতার অনুষ্ঠানে শহীদ ও আহত পরিবারের সদস্যরা এ দাবি জানান। এ সময় শহীদ ও আহতদের সস্মরণে সবাই দাড়িয়ে এক মিনিটের নিরবতা পালন করেন। পবিত্র কোরআন পাঠের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। কোরআন থেকে পাঠ করেন মোজ্জাসেমল হক রাজু।
এসময় শহীদদের পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেন, সরকার শহিদদের ভুলে যেতে বসেছে। শহিদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করে না। শহিদদের হত্যায় জড়িত পুলিশদেরকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না। অন্য আসামিরা ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ তাদের ধরছে না।
এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রদল নেতা ও ব্রাক্ষনবাড়িয়া-৫ আসনের নবীনগরবাসীর অন্তপ্রাণ অ্যাডভোটে রাজিব আহসান চৌধূরী পাপ্পু।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দৈনিক যায়যায়দিনের সম্পাদক ও প্রকাশক শফিক রেহমান। চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের সাবেক ডীন অধ্যাপক ড. আহমেদ জামাল আনোয়ারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য ও সাবেক এমপি আবুল খায়ের ভূইয়া, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মামুন হাসান, শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের সাংগঠনিক সম্পাদক এ একে এম আনিসুল হক প্রমুখ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে সম্পাদক শফিক রেহমান বলেন, জুলাই বিপ্লবে যারা আহত ও শহীদ হয়েছে এবং গুম, খুণের শিকার ও কারাভোগ করেছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। আন্দোলনে আহত হয়ে যারা হসপিটালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তাদেরকেও শ্রদ্ধা জানালাম। যারা চলে গেছেন, তারা আর কখনো ফিরে আসবে না। তাদের কথা প্রতি বছর স্মরণ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, যারা ১৭ বছর পর আমাদের দখল হয়ে যাওয়া অফিসে ফিরে আসতে সাহায্য করেছেন তাদের অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আজকের অনুষ্ঠানটি একটি ঐতিহাসিক অনুষ্ঠান। ১৭ বছর পর এই ভবনে প্রথম অনুষ্ঠান হচ্ছে এটি। এর আগে আমি এখন অনুষ্ঠান করার সুযোগ পায়নি। আমার জীবন থেকে ১৭ বছর চুরি হয়ে গেছে।
সাংবাদিক শফিক রেহমান বলেন, যার বিচার আপনারা চাচ্ছেন, সে এখানে এসে কান্নাকাটি করলে আপনারা গলে যাবেন। বিচার হোক তবে বিচার নিয়ে তামাশা করবেন। হাসিনার বিচার হোক আন্তজাতিক আদালতে।
শহীদ রফিকুল ইসলামের মা সুফিয়া বেগম বলেন, আমার সন্তান হত্যার বিচার চাই। আর কারো সন্তান যেন এভাবে হতআ না করা হয়। আমি হাসিনার ফাসি চাই। আমার পরিবারের কর্মক্ষম আর কেউ নেই, কান্নাজড়িত কণ্ঠে ভেঙ্গে পড়েন সুফিয়া বেগম।
এ সময় পাশে থাকা শহীদ রফিকুলের বড় বোন মুনিয়া বলেন, ভাই হত্যার দ্রুত বিচার দাবি করছি। আমার ভাই প্লাস্টিকের কোম্পানিতে চাকরি করতো। সেই পুরো সংসার চালাতো। চট্রগ্রাম রোডে মিছিলের মধ্যে পড়ে পুলিশের গুলিতে মারা যায়। ভাই হারানোর কষ্ট কাউকে বুঝানো যাবে না। ভাই নেই মনে হলে চারদিকে অন্ধকার দেখি। আরেকটি ভাই আছে, সে প্রতিবন্ধি, সংসারে আয় করার কোনো মানুষ নেই। আমাদের কি ভাবে জানি না।
জুলাই বিপ্লবে শহীদ কামরুল ইসলামের বাবা নান্নু মিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলেন, তার ছেলে কোনো রাজনীতি করতো না, সে হাডবোর্ডের কাজ করতো। মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরে গুলিতে মারা যায়। সংসারে সেই ছিলো উপর্জনের একমাত্র মানুষ। বৃদ্ধার চোখে টল টল করে পানি ঝড়ছিলো। তিনি বলেন, বুকটা আমার ফেটে যায়, আল্লাহ এই বিচার করবে। বৃদ্ধ বয়সে আমি এখন কৃষিকাজ করে সংসার চালাচ্ছি, এই ছিলো কপালে।
শহীদ গোলাম নাফিজের পিতা মো, গোলাম রহমান বলেন, আমার ছেলে পড়াশোনায় মেধাবি ছিলো। গোল্ডেন জিপিএ পেয়ে ভর্তি হয়েছিলো, কিন্তু একদিন ক্লাশ করতে পারেনি। র্ফামগেটে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে। সারা দেশের শহীদদের নিয়ে আমি কাজ করছি, ছেলের জন্য সাবার কাজে দোয়া চাই। নিজেকে বিএনপির কর্মী দাবী করে তিনি সন্তান হত্যার বিচার দাবি জানিয়েছেন।
অনুষ্ঠানে সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেছেন শহীদ পরিবারের সদস্যরা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দাবিগুলো হলো- জুলাই বিপ্লবের সকল শহিদ পরিবার যথাযথ মর্যাদা ও আহতদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ, একটি শহিদ স্মৃতি পাবলিক লাইব্রেরি ও শিশু একাডেম্রি প্রতিষ্ঠা, আন্দোলনে ক্ষতিগস্ত শিশুদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের মানসিক সাপোর্ট টিম গঠন এবং জুলাই বিপ্লবের ইতিহাসে নারী ও শিশুদের অবদান তুলে ধরা।
চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের সাবেক ডীন অধ্যাপক ড. আহমেদ জামাল আনোয়ার বলেন, স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাই। ব্রাক্ষণবাড়িয়া -৫(নবীনগর) আসনের বিএনপির প্রার্থী হিসেবে চাই। তিনি বিএনপি সরকারে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারবেন।
অনুষ্ঠানে সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রদল নেতা ও ব্রাক্ষনবাড়িয়া-৫ আসনের নবীনগরবাসীর আপনজন অ্যাডভোটে রাজিব আহসান চৌধূরী পাপ্পু বলেন, জুলাই বিপ্লবের শহীদের হত্যার বিচার চাই, আহতদের উন্নত চিকিৎসা দাবি করছি। বিএনপি নেতা-কর্মীদের মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবী করছি। আমি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়ার ৩১ দফার আলোকে সাম্য, মানবিকতাও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে চাই।
শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের সাংগঠনিক সম্পাদক এ একে এম আনিসুল হক বলেন, আমি আশা করি আপনারা পাপ্পুর সঙ্গে কাজ করবেন, সহযোগীতা করবেন। কিছুদিন পর জাতীয় নির্বাচন হবে, আমরা পাপ্পুকে সংসদে আইনসংক্রান্ত ব্যাপারে বিশ্লেষন যেন করতে পারে এবং বিএনপি সরকারকে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার সুযোগ করে দিতে পারে।
অনুষ্ঠান শেষে জুলাই বিপ্লবে শহীদ-আহতদের পরিবার এবং কারাভোগকারী বিএনপি নেতা-কর্মীদের সম্মাননা প্রদান করা হয়। এ সময় সম্পাদক শফিক রেহমান সম্পাদিত ‘রাষ্টনায়ক জিয়াউর রহমান’ শীর্ষক বই ও একটি লাল গোলাপ তুলে দেয়া হয়।
যারা সম্মাননা পেলেন, তারা হলেন- শহীদ নাফিজের মা, শহীদ কামরুলের বাবা, শহীদ রফিকের মাতা, শহীদ সুজয়ের ভাই, নবীনগর উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পদক ও কারা নির্যাতিত নেতা গোলাম কিবরিয়া শিবলী, ঢাকা মহানগর পূর্ব ছত্রদলের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. তোফাজ্জল হোসাইন খান, বড়াইল ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. শামীম খান, নবীনগন পৌর যুবদলের কারা নির্যাতিত নেতা ইমাম হোসেন অনিক, আহমেদ রুবেল, সজিব মিয়া এবং নবীনগর উপজেলা ও পৌর স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা আল আমীন মোল্লা, জাহিদুল ইসলাম রতন, মো. বাহাদুর মিয়া, নবীনগর পৌর ছাত্রদলের সদস্য সচিব মেহেদী হাসান ও নবীনগর সরকারি কলেজ ছাত্রদলের কারা নির্যাতিত নেতা আরিফুল ইসলাম রুবেল, ইয়াসির আরাফাত রিমন, নাইমুল ইসলাম প্রমুখ।