Jaijaidin

হাসিনার আমলে সীমান্তে ৫২৭ বাংলাদেশি খুন

Shah Alam Soulav
9 Min Read

গাফফার খান চৌধুরী

জুলাই বিপ্লবে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ-ইনডিয়া সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কমেছে। তবে দুই দেশের সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে বিরাজ করছে চাপা উত্তেজনা। এসব ঘটনা পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখছে দুই দেশের গোয়েন্দা সংস্থা। এদিকে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ইনডিয়ায় পালিয়ে যাওয়ার পরও সীমান্তে হত্যাকাণ্ড কমার বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। ভবিষ্যতে সীমান্তে হত্যা আরো কমবে বলে আশাবাদী তারা।

দেশের শীর্ষপর্যায়ের একটি সরকারি সংস্থার পরিসংখ্যান অনুসারে ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত শুধু বিএসএফের হাতে নিহত হয়েছেন ৪২১ জন বাংলাদেশি। এর বাইরে ইনডিয়ার নাগরিক কর্তৃক নিহত হয়েছেন ১০৬ জন বাংলাদেশি। গত বছর জুলাই বিপ্লবের পর ডিসেম্বর পর্যন্ত ইনডিয়ার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে ছয়জন এবং ইনডিয়ার নাগরিকদের হাতে পাঁচজন বাংলাদেশি নিহতের ঘটনা ঘটেছে। অথচ গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ইনডিয়ার জনগণ কর্তৃক কোনো বাংলাদেশি হত্যার ঘটনা ঘটেনি।

সরকারের একটি উচ্চ পর্যায়ের সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত বিএসএফের গুলিতে ১৩ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন সীমান্তে। একই সময় বিএসএফ কর্তৃক ৩৫ জন ও ইনডিয়ার নাগরিক কর্তৃক দুজন বাংলাদেশি আহত হন। জুলাই বিপ্লবের পর শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সীমান্তে আশাতীতভাবে কমে যায় নানা ধরনের অপরাধ। বিশেষ করে বহুল আলোচিত সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যার মতো ঘটনা। গত বছরের জুলাই থেকে একই বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএসএফের গুলিতে ছয়জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। এছাড়া ইনডিয়ার নাগরিকদের হাতে পাঁচজন বাংলাদেশি নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। একই সময় বিএসএফ কর্তৃক ৩৩ জন এবং ইনডিয়ার নাগরিক কর্তৃক সাতজন বাংলাদেশি আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে, যা শেখ হাসিনার সরকারের সময়ের তুলনায় বেশ কম।

দায়িত্বশীল একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, হাসিনা সরকারের পতনের পর ইনডিয়ার কতিপয় জনগণের হাতে পাঁচ বাংলাদেশির নিহতের ঘটনাটি রীতিমতো রহস্যের জন্ম দিয়েছে। সত্যিকার অর্থেই তারা ইনডিয়ার নাগরিকদের হাতে নিহত হয়েছেন, নাকি সুদূরপ্রসারি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ওই পাঁচ বাংলাদেশিকে হত্যা করা হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। এজন্য ঘটনাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। একই সঙ্গে ইনডিয়ার শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও ঘটনাগুলো অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিবেচনা করে গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখছে।

দায়িত্বশীল এক শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে বাংলাদেশকে সরাসরি সহায়তা করে ইনডিয়া। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে ইনডিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্ক খুবই চমৎকার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। তিনি বর্তমানে ইনডিয়ায় রয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে দুই দেশের সীমান্তে স্বাভাবিক কারণেই নীরব উত্তেজনা রয়েছে। কোনো সময় সেই উত্তেজনা প্রকাশ্যে চলে আসছে। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলির ঘটনাও ঘটছে না। সবকিছুই স্বাভাবিক নিয়মে চলছে।

দায়িত্বশীল ওই কর্মকর্তা বলেন, সীমান্তে প্রায়ই ইনডিয়ান ও বাংলাদেশির মধ্যে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। অতীতেও ঘটেছে। সম্প্রতি নতুন করে ঘটছে। এসব ঘটনায় হতাহতও হয়েছেন দুই দেশের অনেক নাগরিক। এসব ঘটনা সাধারণ মানুষের মধ্যে বেশ উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে মানুষের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে, এসব নিছক ঘটনা, নাকি সুদূরপ্রসারি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কোনো সুবিধাবাদী শ্রেণি বা গোষ্ঠী ঘটাচ্ছে। দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে ফাটল ধরাতেই কোনো সুবিধাবাদী গোষ্ঠী এমনটি করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সীমান্তে হত্যাসহ সব ধরনের অপরাধ ও অপ্রীতিকর ঘটনা কমিয়ে আনার বিষয়ে বিজিবি সদর দপ্তরের উপমহাপরিচালক (মিডিয়া) কর্নেল শরীফুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ-ইনডিয়া সীমান্তে হত্যাসহ যে কোনো অপরাধ ও অপ্রীতিকর ঘটনা ঠেকাতে বিজিবির বাড়তি ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে। সে সঙ্গে জোরদার করা হয়েছে টহল ব্যবস্থা। বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি। সার্বিক পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

এসব বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক এহসানুল হক বলেন, যে কোনো দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে কোনো দেশের নাগরিকের মৃত্যু হলে তার দায় দুই দেশের সরকারেরই থাকে। বাংলাদেশ-ইনডিয়া সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে কোনো বাংলাদেশি মারা গেলে তার দায় যেমন ইনডিয়া সরকারের থাকে, তেমনি বাংলাদেশ সরকারও ওই মৃত্যুর দায় এড়াতে পারে না। তাই এসব ইসু সৃষ্টি যত কম হয়, ততই দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের জন্য ভালো।

তিনি আরো বলেন, ইনডিয়ার নাগরিকদের হাতে বাংলাদেশিদের হতাহতের ঘটনারও দায় এড়াতে পারে না কোনো দেশই। তাই এসব ক্ষেত্রে দুই দেশেরই কূটনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা করে একটি সমাধানে আসা প্রয়োজন। এতে কূটনৈতিক সম্পর্ক যেমন ভালো থাকবে, একই সঙ্গে সীমান্তে অপ্রীতিকর ঘটনাও কম ঘটবে। সীমান্তে হত্যাসহ যে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে, দুই দেশকেই সমানভাবে আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন। এতে দুই দেশেরই অর্থনৈতিকসহ সার্বিক বিষয়ে লাভ হবে। এজন্য দুই দেশের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সম্পর্ক আরো জোরালো করা প্রয়োজন।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার বাল্লা সীমান্তের বড়কিয়া এলাকায় জহুর আলী (৫০) নামে এক বাংলাদেশিকে কতিপয় ইনডিয়ান ও বিএসএফ সদস্য মিলে পিটিয়ে হত্যা করে। হত্যার পর লাশ ইনডিয়ার পুলিশ ত্রিপুরা রাজ্যের খোয়াই মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যায়।

পরদিন ৮ জানুয়ারি সুনামগঞ্জ জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার মাছিমপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হন বাংলাদেশি যুবক সাইদুল ইসলাম (২৩)। অবৈধভাবে বাংলাদেশি সুপারি ইনডিয়ায় পাচারের সময় বিএসএফের গুলিতে মারা যান তিনি। বিজিবির ২৮ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক একেএম জাকারিয়া কাদির জানান, ১৯৩ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের করাইগড়া ক্যাম্পের দায়িত্বপূর্ণ সীমান্ত পিলার ১২০৯-এর কাছ থেকে আনুমানিক ২০ থেকে ২২ গজ ইনডিয়ার ভেতরে গামারীতলা নামক স্থানে বাংলাদেশি ওই যুবক চোরাচালানের উদ্দেশ্যে ঢুকেছিলেন। এ সময় ১৯৩ ব্যাটালিয়ন বিএসএফের করাইগড়া ক্যাম্পের টহল দল চোরাকারবারিকে লক্ষ্য করে ফায়ার করলে ওই যুবক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন।

এছাড়া সম্প্রতি চাপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তের কিরণগঞ্জ সীমান্তে ইনডিয়ানদের সঙ্গে সেখানকার বাংলাদেশিদের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বিএসএফ টিয়ারশেল ছোড়ে। সংঘর্ষ অন্তত পাঁচজন আহত হন। প্রায় ৯ ঘণ্টা পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। এরপর থেকে দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে।

এদিকে ইনডিয়ার রাজধানী নয়াদিল্লিতে গত ১৭ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি ৫৫তম সীমান্ত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলন শেষে বেশকিছু বিষয়ে একমত পোষণ করে বিজিবি ও বিএসএফ। এগুলো হলোÑ সীমান্তে নিরস্ত্র নাগরিকদের ওপর গুলি চালানো, হত্যা, আহত বা মারধরের ঘটনা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যে সীমান্তের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় যৌথ টহল বৃদ্ধি, উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী উপকৃত হবে, এমন তাৎক্ষণিক এবং আগাম গোয়েন্দা তথ্য একে অপরের মধ্যে আদান-প্রদান, সীমান্তবর্তী এলাকায় বসবাসরত জনসাধারণের মধ্যে জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ, বিভিন্ন ধরনের আর্থসামাজিক ও উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ এবং সীমান্তে যে কোনো হত্যা সংঘটিত হলে তার যথাযথ তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে কোনো স্থাপনা, কাঁটাতারের বেড়া, প্রতিরক্ষায় ব্যবহৃত হয়, এমন কোনো স্থাপনা বা বাংকার নির্মাণের ক্ষেত্রে উভয় দেশের যথাযথ কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ পরিদর্শক দলের পরিদর্শন এবং যৌথ আলোচনার দলিলের ভিত্তিতে নির্মাণের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এছাড়া সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে বন্ধ থাকা অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজের ব্যাপারে যথোপযুক্ত পর্যায়ে জয়েন্ট ভেরিফিকেশনের (যৌথ যাচাই) মাধ্যমে দ্রুত সমাধান করা হবে।

বিভিন্ন ধরনের আন্তঃসীমান্ত অপরাধ দমন, বিশেষ করে ফেনসিডিল, ইয়াবা, গাঁজাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য ও গবাদিপশু পাচার রোধ, অবৈধ অনুপ্রবেশ, মানব পাচার, স্বর্ণ, অস্ত্র, জাল মুদ্রার নোট প্রভৃতি চোরাচালান রোধ এবং এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সম্পর্কে তাৎক্ষণিক তথ্য আদান-প্রদান করা হবে।

আন্তর্জাতিক সীমানা আইন লঙ্ঘন করে উভয় দেশের নাগরিক ও বাহিনীর সদস্যদের অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমের ফলে সৃষ্ট ভুল বোঝাবুঝি ও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে সীমান্তে উভয় বাহিনীর নজরদারি বৃদ্ধির পাশাপাশি দুই দেশের সীমান্তবর্তী জনসাধারণকে অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করা থেকে বিরত রাখতে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।

মানব পাচার রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, বিশেষ করে মানব পাচারের মতো অমানবিক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত উভয় দেশের অপরাধী বা দালালচক্রের কার্যক্রম প্রতিরোধে পরস্পরকে সহায়তা এবং মানব পাচারের শিকার ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্ট দেশের প্রচলিত দেশের আইন অনুযায়ী উদ্ধার ও পুনর্বাসন করা হবে।

উভয় পক্ষ ‘সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার’ আওতায় পারস্পরিক আস্থা বৃদ্ধির জন্য গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়নে উভয় বাহিনীর পারস্পরিক সহযোগিতার প্রশংসা করেন। উভয় পক্ষ আগামী দিনে যৌথ খেলাধুলা, জয়েন্ট রিট্রিট সেরিমনিসহ বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে।

এছাড়া আগরতলা থেকে আখাউড়ার দিকে প্রবাহিত সীমান্তবর্তী চারটি খালের বর্জ্য পানি অপসারণে উপযুক্ত পানি শোধনাগার স্থাপন, জকিগঞ্জের কুশিয়ারা নদীর সঙ্গে রহিমপুর খালের মুখ উন্মুক্তকরণ, আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সম্ভাব্য অবস্থান এবং তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *