Jaijaidin

গাজায় নিহতের সংখ্যা ৪০০ ছাড়াল, হামাসের শীর্ষ কর্মকর্তারা নিহত

Shah Alam Soulav
6 Min Read

যাযাদি ডেস্ক

গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর ‘ব্যাপক হামলা’য় চার শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মঙ্গলবার এ পরিসংখ্যান জানিয়েছে।

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, তারা হামাসের ‘সন্ত্রাসী লক্ষ্যবস্তুতে’ আক্রমণ চালাচ্ছে। হামলা অব্যাহত রয়েছে এবং আইডিএফ নতুন করে আরো অনেক এলাকা খালি করার নির্দেশ দিয়েছে।

গত ১৯ জানুয়ারি শুরু হওয়া যুদ্ধবিরতির পর এটি গাজায় সবচেয়ে বড় বিমান হামলা। যুদ্ধবিরতি বাড়ানোর আলোচনা কোনো চুক্তিতে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়েছে।

এদিকে গাজার উপস্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ওই অঞ্চলের সর্বোচ্চ পদস্থ হামাস নিরাপত্তা কর্মকর্তা মাহমুদ আবু ওয়াফাহ নিহত হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে আরো তিনজন শীর্ষ কর্মকর্তা নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, গাজার বাসিন্দারা সাহরি খাওয়ার সময় এসব বিস্ফোরণ হয়। তারা ভয়াবহ পরিস্থিতির বর্ণনা দেন—চারপাশে আগুন, মৃতদেহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে এবং আহতরা চিকিৎসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক বিবৃতিতে জানানো হয়, প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ মঙ্গলবার সকালে এই হামলার নির্দেশ দেন। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘এটি আমাদের জিম্মিদের মুক্তি দিতে বারবার হামাসের অস্বীকৃতি জানানো এবং মার্কিন প্রেসিডেন্টের দূত স্টিভ উইটকফ ও মধ্যস্থতাকারীদের দেওয়া সব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পরবর্তী পদক্ষেপ।

এখন থেকে ইসরায়েল হামাসের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তি প্রয়োগ করবে।’
ইসরায়েলের দাবি, হামাস এখনো ৫৯ জন জিম্মিকে আটকে রেখেছে, যাদের মধ্যে ২৪ জন জীবিত বলে মনে করা হচ্ছে। এদের সবাইকে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ২০২৩ জিম্মি করা হয়েছিল। ইসরায়েলের জাতিসংঘ দূত ড্যানি দানন হামাসকে সতর্ক করে বলেছেন, ‘আমরা আমাদের শত্রুদের প্রতি কোনো দয়া দেখাব না।’

কিন্তু জিম্মিদের পরিবারের প্রতিনিধিত্বকারী একটি গোষ্ঠী অভিযোগ করেছে, ইসরায়েলি সরকার ‘জিম্মিদের ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি এড়িয়ে গেছে’।

হোস্টেজ অ্যান্ড মিসিং ফ্যামিলিস ফোরাম এক বিবৃতিতে বিস্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছে, ‘আমাদের প্রিয়জনদের ফেরানোর প্রক্রিয়াকে ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।’

‘ভয়ানক রাত’

স্থানীয় সময় মঙ্গলবার ভোরে গাজা সিটি, রাফা ও খান ইউনিসে ইসরায়েলি বিমান হামলা চালানো হয়। ২৫ বছর বয়সী রামেজ আলাম্মারিন এএফপিকে জানান, তিনি গাজার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে আহত শিশুদের হাসপাতালে নিয়ে যান। তিনি আরো বলেন, ‘তারা আবারও গাজায় নরকের আগুন ঝরিয়েছে। মৃতদেহ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চারপাশে পড়ে রয়েছে, আর আহতরা কোনো ডাক্তার পাচ্ছে না।’

মোহাম্মদ বদেইর রয়টার্সকে বলেন, ‘আমরা ঘুমিয়ে ছিলাম, তারপর হঠাৎ হামলার শব্দে জেগে উঠি। আমাদের প্রতিবেশীদের বাড়ি লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছিল। আমরা ধ্বংসস্তূপের নিচে এই মেয়েটিকে পাই, তার মা-বাবাকেও টেনে বের করি।’

তিনি আরো বলেন, পরবর্তীতে তার নিজের মেয়ের দেহ ধ্বংসস্তূপের নিচে পাওয়া যায়। এ ছাড়া গাজার আল-মাওয়াসিতে কর্মরত ইউনিসেফের মুখপাত্র রোসালিয়া বোলেন বিবিসি রেডিও ৪কে বলেন, ‘এটি সবার জন্য একটি ভয়ানক রাত ছিল।’

বাইরে চিৎকার ও সাইরেনের শব্দ শোনা যাচ্ছিল, আর উপরে প্লেন উড়ছিল জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘খুব জোরে বিস্ফোরণের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়, আমাদের গেস্ট হাউস কাঁপছিল। পরবর্তী ১৫ মিনিটে, প্রতি পাঁচ বা ছয় সেকেন্ডে একবার করে বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল।’

স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আহতদের সংখ্যা সামাল দিতে স্বাস্থ্যব্যবস্থা হিমশিম খাচ্ছে। হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, আহতের সংখ্যা ৬৬০-এর বেশি। ওই অঞ্চলের ৩৮টি হাসপাতালের মধ্যে ২৫টি সেবা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।

গাজার হাসপাতালগুলোর মহাপরিচালক মোহাম্মদ জাকুত বিবিসি আরবিকে জানান, আহতদের মধ্যে অনেকেরই পোড়া ও ভাঙা হাড়ের মতো গুরুতর আঘাত রয়েছে এবং অনেকে এখনো অস্ত্রোপচারের অপেক্ষায় আছেন। তিনি বলেন, ‘হামলাগুলো এত আকস্মিক হয়েছিল যে পর্যাপ্ত মেডিক্যাল স্টাফ উপস্থিত ছিলেন না, এবং এই ব্যাপক হামলার মাত্রার কারণে সঙ্গে সঙ্গে অতিরিক্ত দল ডাকতে হয়েছে।’

প্রতিক্রিয়া

এদিকে জাতিসংঘ কর্মকর্তারা এই হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। দখলকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলের জন্য জাতিসংঘের মানবিক সমন্বয়কারী মুহান্নাদ হাদি বলেন, ‘এটি অকল্পনীয়। যুদ্ধবিরতি অবিলম্বে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা উচিত। গাজার মানুষ অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করছে।’

হামাস এই হামলার তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করার জন্য ইসরায়েলকে বিশ্বাসঘাতক বলে অভিযুক্ত করেছে। তারা আরো বলেছে, ইসরায়েল অবশিষ্ট জিম্মিদের ‘এক অনিশ্চিত পরিণতির’ সম্মুখীন করেছে।

তবে হামাস এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ পুনরায় শুরু করার ঘোষণা দেয়নি। বরং মধ্যস্থতাকারী ও জাতিসংঘকে হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানিয়েছে। অন্যদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন এই হামলার আগে ইসরায়েলের সঙ্গে পরামর্শ করেছিল। ফক্স নিউজকে হোয়াইট হাউসের এক মুখপাত্র এ তথ্য জানিয়েছেন।

অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির প্রথম পর্ব ১ মার্চ শেষ হওয়ার পর মধ্যস্থতাকারীরা নতুন সমঝোতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাব করেছিল, যুদ্ধবিরতির প্রথম পর্বটি এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাড়ানো হোক, যাতে হামাসের হাতে থাকা জিম্মিদের মুক্তি ও ইসরায়েলে বন্দি ফিলিস্তিনিদের বিনিময় অব্যাহত রাখা যায়। কিন্তু মধ্যস্থতাকারী আলোচনায় জড়িত এক ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা বিবিসিকে জানিয়েছেন, ইসরায়েল ও হামাস এই চুক্তির মূল কিছু শর্ত নিয়ে একমত হতে পারেনি।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের চালানো হামলায় প্রায় এক হাজার ২০০ জন নিহত হয়েছিল, যাদের বেশির ভাগই বেসামরিক নাগরিক। পাশাপাশি সেই হামলায় ২৫১ জনকে জিম্মি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল সামরিক অভিযান চালায়। হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এতে এখন পর্যন্ত ৪৮ হাজার ৫২০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, যাদের বেশির ভাগই বেসামরিক নাগরিক। পাশাপাশি গাজার ২১ লাখ জনসংখ্যার বেশির ভাগই বাস্তুচ্যুত হয়েছে, অনেকেই একাধিকবার। প্রায় ৭০ শতাংশ ভবন ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, স্বাস্থ্যসেবা, পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে এবং খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধ ও আশ্রয়ের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *