Jaijaidin

আজ কাওসার আহমেদ চৌধুরীর মৃত্যুবার্ষিকী

Shah Alam Soulav
5 Min Read

যাযাদিপ্র ডেস্ক

 

বাংলা গানের কিংবদন্তি গীতিকার কাওসার আহমেদ চৌধুরী। তাঁর লেখা “আমায় ডেকো না, ফেরানো যাবে না”, “যেখানে সীমান্ত তোমার, সেখানে বসন্ত আমার”, “আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে”, “এই রূপালি গিটার ফেলে”, “কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে”— এমন অসংখ্য জনপ্রিয় গান সংগীতপ্রেমীদের হৃদয়ে স্থায়ী আসন গেড়েছে। ২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি আমাদের ছেড়ে গেলেও, তাঁর সৃষ্টি আজও বেঁচে আছে। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে বিশেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রকাশিত হলো নতুন গান ‘ঋত্বিক স্মরণে’।

গানটি উৎসর্গ করা হয়েছে কাওসার আহমেদ চৌধুরী এবং ঋত্বিক ঘটক—এই দুই শিল্পীমনকে, যাঁরা নিজেদের সৃষ্টির মাধ্যমে চিরকাল বেঁচে থাকবেন। গানটির কণ্ঠশিল্পী নাফিস কামাল জানান, এটি তাঁর জন্য বিশেষ আবেগের কারণ, তাঁর জীবনের প্রথম গান ‘এলোমেলো’-এর স্রষ্টাও ছিলেন কাওসার আহমেদ চৌধুরী, আর সুরকার ছিলেন নকীব খান। ১৯৯৯ সালে ‘ইত্যাদি’তে প্রচারের পর গানটি তখন দারুন প্রশংসিত হয়। দীর্ঘ বিরতির পর তিনি আবার ফিরে এলেন ‘ঋত্বিক স্মরণে’ গানের মাধ্যমে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি, ঋত্বিকের প্রয়াণ দিবসে এক লাইভ আড্ডায় এসে শিল্পী নাফিস কামাল ঘোষণা দেন ২২ ফেব্রুয়ারি, কাওসার আহমেদ চৌধুরীর মৃত্যুদিবসে অফিসিয়াল মিউজিক ভিডিও রিলিজ করা হবে। ইতিমধ্যে গানটির অডিও ভার্সন ১৪ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পায় এবং শ্রোতাদের মধ্যে ভিন্নধর্মী এ গানটি দারুণ সাড়া ফেলেছে।

গানটির সুর করেছেন সৈয়দ কল্লোল আর সংগীতায়োজনে ছিলেন তুষার রহমান। সাগর সেন ও শেহাজ সিন্ধুর পরিচালনায় এবং “আবোল – তাবোল” টিমের নির্মাণে এই অ্যানিমেটেড মিউজিক ভিডিওটি আজ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় (৭:৩০ মিনিটে) কণ্ঠশিল্পী নাফিস কামালের ইউটিউব, ফেসবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হবে।

গানের লিঙ্ক: https://youtu.be/OJ0AyRsXPsw?si=DtqWMgy95XCE9lK6

‘ঋত্বিক স্মরণে’ গানটির প্রযোজনায় ছিল কুল এক্সপোজার এবং স্পন্সর করেছে ইউনিভার্সাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, যারা দীর্ঘদিন ধরে সৃজনশীল শিল্প-সংস্কৃতি চর্চায় যুক্ত রয়েছে।

গানের প্রেক্ষাপট

ঋত্বিক ঘটকের (জন্ম ১৯২৫, ঢাকা, মৃত্যু, ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৬ ) সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা ও গীতিকার কাওসার আহমেদ চৌধুরীর নিবিড় সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। তাঁদের শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত ও চলচ্চিত্র চর্চায় বাঙ্গালীর গভীর জীবনবোধ, আপামর মানুষের দূর্দশা, জীবন-সংগ্রাম বারবার চিত্রিত হয়ে উঠেছিল।

ঋত্বিক ঘটকের নিবিড় সান্নিধ্যের স্মৃতি ও তাঁর মৃত্যু গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল গীতিকার কাওসার আহমেদ চৌধুরীকে। ঋত্বিককে নিয়ে যে স্বপ্ন তাঁর সবে ডানা মেলছিল, তা যেন ভেঙ্গে যায়। সেই মর্মবেদনায় তিনি রচনা করেন ‘ঋত্বিক’ গানটি। দীর্ঘ ২৮ বছর পর অপ্রকাশিত এই গানটি কাওসার আহমেদ চৌধুরীর পুত্র প্রতীকের বাল্যবন্ধু সংগীতশিল্পী নাফিস কামালের কণ্ঠে, সৈয়দ কল্লোলের সুরে এক ভিন্নাঙ্গিকের গানে রূপান্তরিত হয়েছে।

আজকের দিনে গানটির প্রকাশ ও চিত্রায়ন বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে আবারও যখন স্বৈরাচার আর গণহত্যার প্রতিবাদে আপামর জনতা রুখে দাঁড়াতে বাধ্য হয়, তখন মনে হয় নিপীড়নকারীদের ছবিগুলো বদলেছে, কিন্তু নিপীড়ন থামেনি। গীতিকার কাওসার আহমেদ চৌধুরীর লালিত আকাঙ্ক্ষা ছিল একটি সত্যিকারের স্বাধীন জাতির স্বপ্ন দেখা, যেখানে মুক্তির সুফল বিকশিত হবে।

গানটির দৃশ্যায়নে আছে গভীর ও বিস্তৃত এক প্রেক্ষাপট। নির্মাতা দল গবেষণানির্ভর ও মেধাসম্পন্ন নির্মাণশৈলী প্রয়োগ করেছেন, যা সময়োপযোগী ও তাৎপর্যপূর্ণ। এই প্রয়াসের সফলতা নির্ভর করবে সকল শ্রোতা-দর্শকের আগ্রহ এবং সহযোগিতার ওপর।

কাওসার আহমেদ চৌধুরী সম্পর্কে

বাংলা গানের জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন কাওসার আহমেদ চৌধুরী। গীতিকার, কবি, চিত্রশিল্পী, জ্যোতিষী এবং মুক্তিযোদ্ধা—বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই শিল্পী ১৯৪৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর সিলেট জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই কবিতা ও জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রতি তাঁর অনুরাগ গড়ে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে পড়াশোনা করলেও চিত্রশিল্পী হওয়ার স্বপ্ন পূরণে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের দিকেও ঝুঁকেছিলেন। এ সময়ে প্রখ্যাত ভারতীয় চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা পরবর্তীতে গভীর বন্ধুত্বে পরিণত হয়।

কাওসার আহমেদ চৌধুরী গীতিকার হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর লেখা জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে: “যেখানে সীমান্ত তোমার, সেখানে বসন্ত আমার”—কুমার বিশ্বজিৎ, “আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে”—নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী, “আমায় ডেকো না, ফেরানো যাবে না”—লাকী আখান্দ, “কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে রাতের নির্জনে”—সামিনা চৌধুরী, “মৌসুমি”—ফিডব্যাক, “এই রূপালি গিটার ফেলে”- আইয়ুব বাচ্চু। তাঁর সৃষ্টিগুলো বাংলা সংগীতপ্রেমীদের হৃদয়ে স্থায়ী আসন গেড়েছে।

জ্যোতিষশাস্ত্রের ক্ষেত্রেও তিনি বিশেষ অবদান রেখেছেন। ১৯৯৯ সাল থেকে দৈনিক প্রথম আলোর সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্র “ছুটির দিনে” তিনি “আপনার রাশি” নামে রাশিফল লিখতেন, যা পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তিনি প্রথাগত জ্যোতিষী ছিলেন না; বরং নিউমারোলজি বা সংখ্যা-জ্যোতিষ পদ্ধতি প্রয়োগ করতেন। রাশিফলের শুরুতেই তিনি লিখতেন, “নিজের ভাগ্য নিজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায় শতকরা ৯০ থেকে ৯৬ ভাগ। বাকিটা ফেট বা নিয়তি।”

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মুজিবনগর সরকারের অধীনে গোয়েন্দা হিসেবে তথ্য সংগ্রহের কাজ করতেন, যা মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ দুইটি। ” ঘুম কিনে খাই” এবং “ভাগ্য জানার উপায়”।

২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি, ৭৭ বছর বয়সে, তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। পরে তাকে আজিমপুরে কবরস্থানে দাফন করা হয়।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *