Jaijaidin

একুশে ফেব্রুয়ারি নতুন শহীদ মিনার উপহার দিচ্ছে চসিক

Shah Alam Soulav
6 Min Read

চট্টগ্রাম ব্যুরো

সংস্কারের নামে চার বছর ধরে গড়িমসি চলছিল চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় নতুন শহীদ মিনার নিয়ে। যার নেপথ্যে নায়ক ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি মো. রেজাউল করিম।

এবার সব গড়িমসি ছিন্ন করে চসিকের বর্তমান মেয়র ও মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন আগামি ২১ ফেব্রুয়ারি নগরবাসীকে উপহার দিতে যাচ্ছেন নতুন এই শহীদ মিনার। যেখানে শহীদ দিবসের শ্রদ্ধা নিবেদনের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।

মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে নগরীর কে সি দে রোডে নবনির্মিত এই শহীদ মিনার পরিদর্শনে গিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের ঘোষণা দেন সিটি মেয়র। মেয়র শাহাদাত হোসেন এ সময় বলেন, সংস্কারের নামে নতুন শহীদ মিনার নির্মাণে নানা অনিয়ম ও এর সঙ্গে যুক্ত নানা স্থাপনা নিয়ে আপত্তি ছিল চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকর্মীদের।

তাদের আপত্তির কারণে ২০২৩ সালে সংস্কারকাজ শেষ হলেও সেখানে শ্রদ্ধা জানানোর উদ্যোগ নেয়নি চসিকের তৎকালীন মেয়র। অস্থায়ী হিসেবে মিউনিসিপ্যাল মডেল স্কুলের শহীদ মিনারে আমরা ফুল দিয়েছি। সেটাও সিটি করপোরেশনের একটি স্কুল।

সেই থেকে পরবর্তী তিন বছর আমরা শ্রদ্ধা জানাতে পারিনি। এবার আমরা আশা করছি চট্টগ্রামের মানুষ ২০২৫ সালে এসে ২১শে ফেব্রুয়ারির ফুল আগের যে ঐতিহ্যবাহী জায়গা, নতুন শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাবে। এ লক্ষ্যে চলছে ধোয়া-মোছার কাজ।

সংস্কৃতিকর্মীদের আপত্তির বিষয় তুলে ধরে মেয়র শাহাদাত বলেন, এই শহীদ মিনারের নকশা যিনি করেছেন তিনি এখন আমেরিকায় আছেন। তবুও আমি গণপুর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। এখানে মিনার যেগুলো আছে সেগুলো আরও লম্বা করা হবে। সেটার জন্য ডিও লেটার দিয়েছি। আলটিমেটলি সেটার কাজও হবে।

চসিকের তথ্যমতে, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, মুসলিম ইনস্টিটিউট হল এবং স্টুডিও থিয়েটার মিলিয়ে একটি সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স বা সাংস্কৃতিক বলয় নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালে। ২০২৩ সালে এর কাজ শেষ হয়। এতে ব্যয় হয়েছে ২৮১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে গণপূর্ত বিভাগ।

প্রকল্পের অধীনে আছে, মুসলিম ইনস্টিটিউট হল ও পাবলিক লাইব্রেরির অংশের পুরনো স্থাপনা ভেঙে ১৫ তলা গণগ্রন্থাগার ও আটতলা অডিটরিয়াম ভবন, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার সংস্কার, ২৫০ জন ধারণক্ষমতার একটি উন্মুক্ত গ্যালারিসহ মুক্তমঞ্চ এবং ক্যাফে ও মিনি মিউজিয়াম।

২০২১ সালের অক্টোবরে পুরনো শহীদ মিনারটি সংস্কারের জন্য ভাঙার আগেই সংস্কৃতিকর্মীদের পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়েছিল। তারা দাবি করেছিলেন, আগের অবয়ব ঠিক রেখেই সংস্কার করতে হবে। তখন তৎকালীন চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী এবং প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, শহীদ মিনারের মূল নকশার কোনো পরিবর্তন করা হবে না।

পরে নির্মাণ কাজ শেষ হলেও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নকশা নিয়ে ২০২৩ সালের নভেম্বরে আপত্তি তুলেছিল চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক সংগঠক ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। এরপর সে সময়ের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি নকশা সংশোধনের ১০টি সুপারিশ করলেও সেগুলো বাস্তবায়নে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।

সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে, প্লাজার দক্ষিণ পূর্বের উন্মুক্ত মঞ্চের পিছনে থাকা গ্রিনরুমের দেওয়ালের উচ্চতা ফ্লোর লেভেল হতে ৬ ফুট বা মঞ্চ হতে ৪ ফুট রেখে অবশিষ্ট অংশ অপসারণ করা। এছাড়া দক্ষিণ পশ্চিমে থাকা লিলি পন্ড ওয়াটার বডি অপসারণ, মূল বেদীর দুই পাশে বাঁকানো গাইড ওয়ালের উচ্চতা কমানো, পূর্ব পার্শ্বের প্রবেশ র‌্যা¤প ও সিঁড়ির মধ্যেকার দেয়াল অপসারণ করে পূর্ণাঙ্গ র‌্যা¤প করার সুপারিশ করা হয়। সেই সুপারিশ অনুযায়ী বর্তমানে শহীদ মিনারের পাশ দিয়ে একটা র‌্যা¤প করা, কিছু দেয়ালের উচ্চতা কমানো এবং মূল শহীদ মিনারের উচ্চতা বাড়ানোর কাজ।

এ বিষয়ে সংস্কৃতিকর্মীদের মন রাখতে গত বছরের ২৮ মে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠাতে উদ্যোগ নেয় চসিক। কিন্তু বিগত সরকারের বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে শেষ পর্যন্ত ওই চিঠি মন্ত্রণালয়ে আর পাঠাননি সংস্থাটির প্রধান। শেষে ফাইলচাপা পড়ে যায় ওই চিঠি। এমনকি সুপারিশ বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞ কমিটি করেই দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে সংস্থাটি। গণপূর্ত অধিদপ্তরে চিঠি পাঠানোর কথা থাকলেও সেটিও আর পাঠায়নি চসিক।

তবে গত সপ্তাহের শেষে এ নিয়ে টনক নড়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের। চলতি সপ্তাহের শুরুতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় নগরবাসী শ্রদ্ধা জানাতে পারবেন সেখানে। অতঃপর এবারের ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে পর্দা উঠবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, বিষয়টা নিয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে একটা চিঠি পাঠানোর কথা ছিল। নানান কারণে তা সে সময় আর হয়নি। তবে এবার আমরা এ বিষয়ে একটা জোরালো পদক্ষেপ নিবো।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্সের প্রকল্প বাস্তবায়নকারী গণপূর্ত বিভাগের চট্টগ্রাম অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী-১ কামরুল হাসান খান বলেন, সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের মধ্যে র‌্যা¤েপর পাশে বাড়ানোর কাজ চলছে। এটা একুশে ফেব্রুয়ারির আগেই আমরা শেষ করতে পারবো। আর শহীদ মিনারের আশপাশে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, ধোয়া-মোছার কাজ চলছে।

উল্লেখ্য, ১৯৬২ সালে নগরের কেসি দে রোডে পাহাড়ের পাদদেশে প্রথম শহীদ মিনারটি নির্মাণ করা হয়। পরে ১৯৭৪ সালে এর নতুন রূপ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ২০২১ সালে তৎকালীন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের উপস্থিতিতে সাংস্কৃতিক কর্মীদের সঙ্গে সভা করে পুরনো শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।

এর পরের বছর ২০২২ সালের জানুয়ারিতে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের অধীনে সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স প্রকল্পের আওতায় পুরনো শহীদ মিনারটি ভেঙে নতুন শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এরপর মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুল মাঠে অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ করে দেয় গণপূর্ত অধিদপ্তর। তারপর থেকে সেখানেই শ্রদ্ধা নিবেদন করেন নগরবাসী।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *