মাহবুবুর রহমান
‘বডি শেমিং’, ‘মানসিক নির্যাতন’, ‘গালাগাল’ বাংলাদেশের ফুটবলের ইতিহাসে কোনো নারী ফুটবল দলের কোচের বিরুদ্ধে এমন মারাত্মক সব অভিযোগ বোধহয় আগে কখনো ওঠেনি। গত ৩০ জানুয়ারি তিন পৃষ্ঠার বিবৃতিতে কোচ পিটার বাটলারের বিরুদ্ধে এমনই ভয়ংকর অভিযোগ এনেছিলেন বিদ্রোহী ১৮ নারী ফুটবলার। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায়, বাটলার থাকলে তারা দলে থাকবেন না, আর তারা দলে থাকলে বাটলার কোচিং করাবেন না। প্রয়োজনে গণপদত্যাগ করতেও রাজি ছিলেন ওই ১৮ ফুটবলার। কোচ-ফুটবলারদের মধ্যে দ্বন্দ্ব যখন এমন পর্যায়ে, সে সময়ই বাফুফে নারী উইংয়ের চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ জানান, অবসান হয়েছে ‘ভুল বোঝাবুঝি’র।
রোববার কিরণ সংবাদ সম্মেলন করে একথা জানালেও কোনো নারী ফুটবলারের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বরং তারা আপাতত ছুটিতে যাচ্ছেনÑ এমনটাই জানিয়েছে বাফুফে। তাই নারী ফুটবলের সংকট সত্যিই কতটা সমাধান হয়েছে, তা নিয়ে সংশয় রয়েই গেছে।
কিরণ নারী ফুটবলারদের সঙ্গে কোচের ‘দ্বন্দ্ব’কে ‘ভুল বোঝাবুঝি’র তকমা দিয়ে হালকা করার চেষ্টা করলেও কোচের সঙ্গে ফুটবলারদের এই দূরত্বের পেছনে তাকালে দেখা যায় দীর্ঘ ট্রেইল। তথ্যমতে, বাটলারের সঙ্গে নারী ফুটবলারদের এই দ্বন্দ্ব সাম্প্রতিক নয়। ঘটনার সূত্রপাত ২০২৪ সালে নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে। সেসময় অভিযোগ ছিল, বাটলার সিনিয়র-জুনিয়র ফুটবলারদের মধ্যে বৈষম্য করেছেন। বিভিন্ন কৌশলে সিনিয়র-জুনিয়রদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করার চেষ্টা করেছেন। ফুটবল সংশ্লিষ্ট সবারই এসব তথ্য জানা। পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে, দ্বিতীয়বারের মতো নারী সাফের শিরোপা জেতা সাবিনাদের পক্ষে সম্ভব হবে কি না, তা নিয়েও দেখা দিয়েছিল সন্দেহ। তবে সবকিছু ছাপিয়ে পূর্বের মতোই সিনিয়র-জুনিয়র মধুর সম্পর্ক বজায় রেখে মাঠে লড়াই করে সাফের শিরোপা জিতেছিলেন সাবিনারা। সে টুর্নামেন্টে খেলোয়াড়রা কোচের নির্দেশ উপেক্ষা করে নিজেদের মতো খেলে সাফল্য এনেছিলেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে।
সেই সাফের শিরোপা জয়ের পর এক ফুটবলার প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, ‘বাটলার থাকলে তার অধীনে খেলব না।’ তখন থেকেই নারী ফুটবলারদের জোর দাবি বাটলারকে কোচ হিসেবে না রাখার। কিন্তু সব দাবি পেছনে ফেলে দ্বিতীয়বারের মতো বাটলারকেই নারী দলের কোচের দায়িত্বে চুক্তিবদ্ধ করে বাফুফে। বিষয়টি দলের একটি বড় অংশ কিছুতেই মেনে নিতে চায়নি। একসময় বিদ্রোহীদের সংখ্যাটা একটা নির্দিষ্ট গণ্ডিতে চলে আসেÑ ১৮ জন। মূলত যখন তারা লিখিতভাবে অভিযোগ জানান।
অবাক করা বিষয় হলো, যাদের ‘বিদ্রোহী’ তকমা দেয়া হচ্ছে, তাদের বড় একটা অংশ বছরের পর বছর নারী ফুটবলে সাফল্য এনে দিয়েছেন। প্রথম ও দ্বিতীয় নারী সাফ জয়েও ছিল তাদের বড় অবদান। বিশেষ করে দীর্ঘদিন ধরে নারী ফুটবল দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করা ‘সাবিনা খাতুন’, যাকে সাবেক সফল কোচ ছোটন প্রশংসা করে ডাকতেন ‘লিডার’ বলে। সেই সাবিনাই যেন এখন ভিলেন, ‘বিদ্রোহীদের লিডার’।
বিশ্লেষকদের মতে, নারী ফুটবলের এই সংকটের দায় ফুটবলারদের একার নয়। বাফুফে কোচ হিসেবে কাকে রাখবে না রাখবেÑ সে বিষয়ে ফুটবলারদের দাবি তোলাটা যেমন দলের শৃঙ্খলাভঙ্গের শামিল। তেমনি কোচ পিটার বাটলারের একের পর এক বিতর্কিত মন্তব্য করা, ফুটবলারদের সঙ্গে তার দ্বন্দ্বের সমাধান না করে অ্যাকাডেমির দায়িত্ব পালন করতে আসা কোচকে দ্বিতীয়বার জাতীয় দলের দায়িত্ব তুলে দেয়াটাও বাফুফে নারী উইংয়ের ব্যর্থতা ছিল।
অবশ্য রোববার কিরণ অনেকটা ‘জরুরি কমিটির’ কাঁধে দায় চাপিয়ে বিষয়টির এভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ‘নারী উইং নিয়ে ভুল তথ্য যাচ্ছে, সেটা পরিষ্কার করে বলতে চাই। নারী উইং খেলোয়াড়দের সঙ্গে এককভাবে ও একসঙ্গে বসেছিল। নারী উইং থেকে এই কোচকে না রাখার সুপারিশ করা হয়েছিল। কোচ নিয়োগ হয়েছে জরুরি কমিটির সভায়। যেখানে সভাপতি ও সহ-সভাপতিরা (সিনিয়র সহ-সভাপতিও আছেন) রয়েছেন। বাটলার তো আসলে ভালো প্রোফাইল কোচ। সভাপতি নিশ্চয়ই ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’
কিরণের কথায় স্পষ্ট যে, আপাতদৃষ্টিতে নারী ফুটবলে চলমান সংকটে আশার আলো দেখা গেলেও এখনো পূর্ণ সমাধান হয়নি। তিনি বলেন, ‘আমাদের চেষ্টা অব্যাহত ছিল তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য। তারই ধারাবাহিকতায় আজকেও বসেছিলাম। বসার পর বলতে পারি মেয়েরা অনুশীলনে ফিরছে। তবে এখনই ফিরবে না। ২৪ ফেব্রুয়ারি ক্যাম্প বন্ধ হয়ে যাবে। সবার জন্য বন্ধ হবে ক্যাম্প। সিনিয়র খেলোয়াড়রা ব্রেক চাইছে। ওদের জন্য ব্রেক হবে। তারপর ওরা ক্যাম্পে ফিরে অনুশীলন করবে। এর আগে আমরা যা করব বাফুফে, কোচ ও খেলোয়াড়সহ সবার সঙ্গে বসে ভুল বোঝাবুঝি যা ছিল তা মিটিয়ে দেয়া হবে।’
এখন দেখার বিষয় শেষ পর্যন্ত কোচ-খেলোয়াড়দের এই দ্বন্দ্ব কতটা বিচক্ষণতার সঙ্গে সমাধান করতে পারে বাফুফের নতুন কমিটি।