আলতাব হোসেন
দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও চালের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে বেশ কয়েক বছর ধরে সুগন্ধি চাল রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। সম্প্রতি এ ধরনের চাল ফের রপ্তানি করার উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সূত্রমতে, চাল রপ্তানিকারকদের একটি সিন্ডিকেটের পেছনে ইন্ধন জোগাচ্ছে। কারণ তারা চায় সুগন্ধির নামে চিকন চাল রপ্তানি করতে। এতে দেশে খাদ্য সংকট চরম আকার ধারণ করবে। চালের দাম কেজিপ্রতি ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। এতে চাপে পড়বে সাধারণ জনগণ।
চাল রপ্তানিকারকরা বলছেন, সুগন্ধি চাল কৃষিপণ্যের রপ্তানি বাড়াতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। এদিকে সুগন্ধি চাল রপ্তানির অনুমতি দিলেও পরিমাণ ও ন্যূনতম দাম বেঁধে দেয়ার কথা ভাবছে সরকার।
দেশের চাল ব্যবসায়ীরা জানান, রপ্তানির সুযোগ দিলে সুগন্ধির নামে সরু বা চিকন চালের সঙ্গে যুক্ত হবে। এতে দেশে চালের সংকট তৈরি হবে, বাড়বে দাম। তারা আরো বলেন, এবার আমন ও বোরো ফলন কম হয়েছে। এতে বছরজুড়েই চালের দাম লাগামহীন। এখন যদি রপ্তানির সুযোগ দেয়া হয়, তাহলে খুচরা বাজারে এই নিত্যপণ্যের দাম আরো বাড়বে।
গত ২২ জানুয়ারি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পর্যবেক্ষণ কমিটির সভায় সুগন্ধি চাল রপ্তানি উন্মুক্ত করার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এক্ষেত্রে রপ্তানি মূল্য ও পরিমাণ নির্ধারণে ১১ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সদস্যরা আছেন।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এ কমিটির প্রধান সংগ্রহ ও সরবরাহ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব জিয়াউদ্দীন আহমেদ। কমিটিতে কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের প্রতিনিধিরা আছেন।
দেশে রপ্তানিযোগ্য সুগন্ধি চালের একটি তালিকা রয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। চালগুলো হলোÑ কালিজিরা, কালিজিরা টিপিএল-৬২, চিনিগুঁড়া, চিনি আতপ, চিনি কানাই, বাদশাভোগ, কাটারিভোগ, মদনভোগ, রাঁধুনিপাগল, বাঁশফুল, জটাবাঁশফুল, বিন্নাফুল, তুলসীমালা, তুলসী আতপ, তুলসী মণি, মধুমালা, খোরমা, সাককুর খোরমা, নুনিয়া, পশুশাইল, দুলাভোগ ইত্যাদি। উৎসব-আয়োজনে এসব চালের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়।
জানা যায়, কমিটি দেশে কী পরিমাণ সুগন্ধি চাল উৎপাদন হচ্ছে, এর মধ্যে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা কতÑ তা নির্ধারণ করবে। এরপর কী পরিমাণ চাল কত দামে বিদেশে রপ্তানি করা যায়, তা উল্লেখ করে তারা প্রতিবেদন জমা দেবেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে চাল রপ্তানির পরিমাণ ও ন্যূনতম দাম বেঁধে অনুমতি দেবে।
এ বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মমকর্তা বলেন, এবার আমন মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহের টার্গেট পূরণ হয়নি। এর মধ্যে এমন সিদ্ধান্ত হবে আগুনে ঘি ঢালার মতো।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জিয়াউদ্দীন আহমেদ বলেন, শিগগির মিটিং করে চাল রপ্তানির বিষয়টি পর্যালোচনা করা হবে। কীভাবে কোন প্রক্রিয়ায় কতটুকু সুগন্ধি চাল রপ্তানি করা হবে, তা নির্ধারণ করা হবে।
কমিটির একজন সদস্য জানান, প্রতি কেজি চাল সরকার যদি এক ডলার ৩০ থেকে ৪০ সেন্ট বেঁধে দেয়, তবে এক কেজি সুগন্ধি চাল রপ্তানি করে তিন কেজি সাধারণ চাল আমদানি করা যাবে। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটবে, পাশাপাশি অন্য কৃষিপণ্য রপ্তানি বাড়বে।
এ বিষয়ে কারওয়ান বাজারের চাল ব্যবসায়ী কুমিল্লা ট্রেডার্সের মালিক বরকত আলী বলেন, বাজারে চালের সংকট তৈরি করা অটো রাইসমিলের একটি সিন্ডিকেট চাল রপ্তানির পাঁয়তারা করছে। তারা রপ্তানির নামে সরকারের কাছ থেকে ২০ শতাংশ প্রণোদনা হাতিয়ে নেবে। এতদিন তারা সরকারের গুদামে চাল বিক্রি করে বিশাল মুনাফা করেছে। এবার তারা নতুন মিশনে নেমেছে।
বাংলাদেশ অ্যাগ্রো-প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ইকতাদুল হক বলেন, ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে সুগন্ধি চাল রপ্তানি শুরু হয়। পরে চালের সংকট তৈরি হলে ২০২২ সালে রপ্তানি বন্ধ করে সরকার। এরপর মাঝে কিছু অনুমতি দিলেও ২০২৩ সালের অক্টোবরে রপ্তানি ফের বন্ধ করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকারকে একটি ফাঁদে ফেলার অপচেষ্টা করা হচ্ছে।
মিরপুর ১১ নাম্বার কাঁচাবাজারের ব্যবসীয় আব্দুল মাখন বলেন, সামনে রোজা ও ঈদ। এ সময় মানুষ সুগন্ধি চিকন চাল বেশি কেনে। অনেকে চাল, ডাল, তেল ও কসমেটিক একসঙ্গে নিতে চান। যদি সুগন্ধি পোলাওর চাল না থাকে দোকানে, তখন ওই ক্রেতা আমার দোকান থেকে অন্যান্য পণ্য না নিয়ে চলে যান। অন্য দোকানে সুগন্ধি চালের সন্ধান করেন। পাওয়া গেলে, সেই দোকান থেকে সব পণ্য কেনেন। এটা চাল নিয়ে চালবাজির ঘটনা ঘটাবে। এমনিতে চালের দামে নাভিশ্বাস উঠেছে ভোক্তাদের।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধতন এক কর্মকর্তা খাদ্য পরিকল্পনা ও পর্যবেক্ষণ কমিটির সভায় জানান, রপ্তানি বন্ধ থাকলেও বাংলাদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সুগন্ধি চাল ইনডিয়াসহ অনেক দেশে পাচার হচ্ছে। কারণ উৎপাদন এলাকায় চালের দাম অনেক কম। বাংলাদেশের বিভিন্ন কম্পানির প্যাকেটে চাল পাচার হচ্ছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী তাদের নিজস্ব ব্রান্ডিং ব্যবহার করে গোপনে বিদেশে রপ্তানি করছেন। এদিকে সরকার চালের মূল্য কমাতে নানা উদ্যোগ নিলেও তা কার্যকর হচ্ছে না।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে জানা যায়, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৮৬ লাখ, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ৮৫ লাখ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫১ লাখ আমেরিকান ডলারের সুগন্ধি চাল রপ্তানি হয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে বছরে গড়ে সুগন্ধি চাল উৎপাদন হয় ১৮ থেকে ২০ লাখ টন, গড়ে রপ্তানি হয় ১০ হাজার টন। অর্থাৎ উৎপাদনের তুলনায় চালের রপ্তানির হিস্যা অনেক কম। দেশের বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, আমেরিকা, বৃটেন, মালয়শিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্রুনাই, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিশ্বের ১৩০টির বেশি দেশে সুগন্ধি চাল রপ্তানি হয়েছে। অন্যদিকে সরকার বিপুল ভর্তুকি দিয়ে ইনডিয়া, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম থেকে ৪০ লাখ টনের বেশি চাল আমদানি করে থাকে।