গাফফার খান চৌধুরী
দেশ-বিদেশ থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে ছড়ানো হচ্ছে গুজব। লক্ষ্য একটাইÑ দেশকে অস্থিতিশীল করা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সোশাল মিডিয়ায় ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে এই অপকর্ম করা হচ্ছে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে। এমন তিন শতাধিক ভুয়া অ্যাকাউন্ট অভিযোগ করে বন্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিদেশে বসে গুজব ছড়ানোর দায়ে মামলা হয়েছে ৬০ জনের বিরুদ্ধে। কিন্তু আসামিরা অধরা। তাদের ইন্টারপোলের মাধ্যমে গ্রেপ্তার করে দেশে ফেরত আনার চেষ্টা করছে সিআইডি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাইবার বিভাগ জানায়, গুজব ঠেকাতে কঠোর মনিটরিং, গোয়েন্দা নজরদারি এবং এর সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারে ধারাবাহিক অভিযান চলছে। প্রতিদিন সারাদেশে সাইবার-সংক্রান্ত বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে গড়ে প্রায় ২৫ জন গ্রেপ্তার হচ্ছে। এরপরও গুজব ছড়ানো বন্ধ করা যাচ্ছে না। শতকরা ৯৫ ভাগের বেশি গুজব ছড়ানো হচ্ছে ভুয়া ফেসবুকসহ অন্যান্য সোশায় মিডিয়া অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে পুলিশের ৬৫২টি থানায় গড়ে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ছয় শতাধিক মামলা হচ্ছে। এসব মামলার মধ্যে ২৫ শতাংশের বেশিই সাইবারকেন্দ্রিক। তবে অধিকাংশ থানায় সাইবার-সংক্রান্ত মামলা তদন্তের মতো পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই। এসব মামলা তদন্তে সহায়তার পাশাপাশি অধিকাংশ মামলার তদন্ত করছে পুলিশের সাইবার ইউনিট।
পুলিশের সাইবার বিভাগ সূত্র জানায়, বর্তমানে সাইবারকেন্দ্রিক অপরাধ বেশি ঘটছে। এসব অপরাধে জড়িতদের অধিকাংশই শিক্ষিত, প্রযুক্তি সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখেন। নারীরা সাইবার বুলিং বা অপরাধের শিকার হন বেশি, যেটা ৪৬ শতাংশের ওপর। এগুলো ব্যক্তিগত পর্যায়ের অপরাধ।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সাইবার অপরাধের প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। দেশকে অস্থিতিশীল করতে পরিকল্পিতভাবে কিছু গোষ্ঠী দেশ-বিদেশ থেকে গুজব ছড়াচ্ছে বা এসব অপরাধে বিভিন্নভাবে সহায়তা করছে। ধর্মীয় স্পর্শকাতর বিষয়কেও টার্গেট করছে অপরাধীরা।
সূত্র জানায়, সবশেষ গত ২ ফেব্রুয়ারি টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমায় আখেরি মোনাজাতের সময় ড্রোন বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। তখন গুজব ছড়িয়ে পড়ে, ময়দানে বোমা হামলা করা হয়েছে। এটি ছিল মাওলানা জুবায়েরপন্থীদের ইজতেমা পর্ব। অভিযোগ ওঠে, মাওলানা সা’দপন্থীরা এই হামলায় জড়িত। ওই ঘটনার পর বিস্ফোরিত ড্রোন কারা ব্যবহার করছিলÑ সে বিষয়ে তদন্ত চলছে।
এর আগে সবার মোবাইল ফোনের কথাবার্তা রেকর্ড, সব ফোন কল রেকর্ডিং ও সংরক্ষণ, হোয়াটসঅ্যাপ পর্যবেক্ষণ, টুইটার নিরীক্ষণ ও ফেসবুক পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলে গুজব ছড়ানো হয়। এ ছাড়া জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন ইসুতে গুজব ছড়ানো হয়েছে। পরে পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগ এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানায়, পুরো বিষয়টিই গুজব।
গুজব সম্পর্কে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মেজর মো. লুৎফুল হাদী বলেন, র্যাবের সাইবার বিভাগ সোশাল মিডিয়া থেকে শুরু করে অন্যান্য মাধ্যম ২৪ ঘণ্টা মনিটর করছে। গুজব ছড়ানোর সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারও করা হচ্ছে। যেসব সোশাল অ্যাকাউন্ট থেকে গুজব ছড়ানো হয়, এর প্রায় শতভাগই ভুয়া। গুজবের বিরুদ্ধে র্যাবের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগ জানায়, দেশে চলমান আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রায় সব ইসুতেই গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এসব অপরাধে জড়িত অর্ধশতাধিক ফেসবুক ও শতাধিক ইউটিউব আইডি শনাক্তের পর বন্ধ করা হয়েছে। তবে যে পরিমাণ অ্যাকাউন্ট বন্ধ করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগে প্রস্তাব পাঠানো হয়, এর শতকরা ১০-১২ ভাগ বন্ধ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন যুক্তি দেখায়। এ ব্যাপারে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একাধিকবার সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে যোগাযোগ করেও আশানুরূপ সাড়া মেলেনি।
সিআইডির সাইবার মনিটরিং বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আলোচিত গুজব ছড়ানোর সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে দেড় শতাধিক ফেসবুক অ্যাকাউন্ট শনাক্ত করে সেটা স্থায়ীভাবে বন্ধ করা হয়েছে। এসব অ্যাকাউন্টের কিছু কিছু অস্ট্রেলিয়া, মালয়শিয়া, বৃটেন, লিবিয়া ও সৌদি আরব থেকে চালানো হচ্ছিল। বিদেশে বসে গুজব ছড়ানোর সঙ্গে জড়িত ৬০ জনের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তার করে দেশে ফেরত আনতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে চেষ্টা চলছে। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছে।
জানা গেছে, গুজব ছড়ানোর জন্য বিশেষ গ্রুপ আছে। ওইসব গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ১০ লাখের বেশি। তারা ছড়িয়ে দেয়া গুজব শেয়ার করে। অপরাধীরা এতটাই দক্ষ যে, তারা সশস্ত্র বাহিনী সম্পর্কেও গুজব ছড়াতে দ্বিধা করে না। এ ছাড়া রাষ্ট্র, সরকারব্যবস্থা, র্যাব, পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনী সম্পর্কেও তারা গুজব ছড়ায়।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ও ন্যাশনাল টেলিকম মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সূত্রগুলো বলছে, দেশের ১৮ কোটি জনগণের মধ্যে ১৩ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। এই সুযোগ নিচ্ছে প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধীরা। তারা ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে গুজব ছড়াচ্ছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের সহকারী মহাপরিদর্শক ইনামুল হক সাগর বলেন, গুজব প্রতিরোধে বিভিন্ন মাধ্যম ২৪ ঘণ্টা মনিটর করা হচ্ছে, বিশেষ করে ফেসবুক। যেসব অ্যাকাউন্ট থেকে গুজব ছড়ানো হচ্ছে, এর অধিকাংশই ভুয়া। বিদেশ থেকেও গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছে পুলিশ।