আলতাব হোসেন
প্রায় পাঁচ বছর ধরে ২৬টি খাল দেখা-শোনা ও পানি প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। এখন পর্যন্ত একটি খালেও পানি প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে পারেনি। যদিও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এরমধ্যে ৩৩০ কোটি টাকা এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ২২০ কোটি টাকা ব্যয় দেখিয়েছে। এ ছাড়াও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন চারটি খাল পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ৯০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিয়েছে। এরমধ্যে দখল, দূষণ ও নগরায়নে বৃদ্ধিতে বেহাল অবস্থায় পড়েছে ঢাকার খালগুলো। এতে বর্ষায় সামান্য বৃষ্টিতে কমোড় পানি নামে জমে রাজধানীর সড়কগুলোতে।
এক সময় ঢাকায় ৪৭টি খাল সচল ছিল। চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল ওই খালগুলো। নৌকা, স্টিমার চলতো সেসব নদীখালে। সেসময় নৌপথে মালামাল পরিবহণ ও বাণিজ্যিক প্রসার ঘটে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অপরূপ ছিল তখন ঢাকা। প্রবাহমান নদী ও খালের সুবিধাই মুঘলদের ঢাকায় রাজধানী প্রতিষ্ঠা করতে উৎসাহিত করে। রাজপ্রাসাদ, দুর্গ রক্ষাসহ রণকৌশল করপোরেশন গড়ে তোলা হয় শহরের খালগুলোকে কেন্দ্র করে।
ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী খালের সংখ্যা ছিলো ৪৭টি। গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের হিসাব অনুযায়ী ঢাকা শহরে ৫৬টি খালের অস্তিত্ব থাকলেও তার সবই মৃতপ্রায়। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাজধানীর খালগুলো উদ্ধারে অভিযান চালিয়েছিল সেনাবাহিনী। তখনো ৪৭টি খাল চিহিৃত করা হয়। ঢাকা ডিটেইল্ড এরিয়া পস্ন্যানে (ড্যাপ) ঢাকায় মোট খালের সংখ্যা ৪৭টি বলে উল্লেখ করে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন রাজধানী ঢাকার খাল সম্পর্কে ৫৭ পৃষ্ঠার এক বিশদ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। খাল হারিয়ে যাওয়ার সব তথ্য রয়েছে ওই প্রতিবেদনে। নদী রক্ষা কমিশন ঢাকাসহ আশপাশের এলাকা মিলিয়ে মোট ৭৭টি খালের অস্থিত্ব চিহ্নিত করেছে। নদী কমিশনের এখন প্রশ্ন-এত খাল হারাল কোথায়?।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তথ্যে জানা যায়, এক সময় শাহবাগ থেকে মগবাজার পর্যন্ত খাল ছিল, ঢাকা ওয়াসার মানচিত্রে এর নাম পরীবাগ খাল। তবে সেখানে এখন খালের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। ঠিক একইভাবে ধোলাইখাল, রায়েরবাজার, আরামবাগ, গোপীবাগ, সেগুনবাগিচা, কাঁঠালবাগান, নারিন্দা, ধানমন্ডি খালের কোনো অস্তিত্বই এখন নেই। রাজধানীর অন্যতম পুরনো খাল আদি বুড়িগঙ্গা। মূলত এটি বুড়িগঙ্গার একটি অংশ, যা বুড়িগঙ্গাকে সংযুক্ত করেছে ধলেশ্বরী ও তুরাগের সঙ্গে। সেই আদি বুড়িগঙ্গা দখল-দূষণে হারিয়ে গেছে। এমন অবস্থা মোহাম্মদপুরের বসিলা এলাকার কাটাসুর ও রামচন্দ্রপুর খালেরও। শুধু এসব এলাকা নয়, রাজধানী ঢাকার সব খালের চিত্র একইরকম।
অনেকগুলো খাল এখন বিলুপ্ত। যেগুলো রয়েছে তার বেশিরভাগই সংকুচিত হয়ে পড়ছে। আগে খালের প্রস্থ ছিল ১৫০ ফুটের বেশি। খালের সঙ্গে নদীর যে যোগাযোগ ছিল তা এখন বিচ্ছিন্ন। খালের পানি এখন আর নদীতে গড়ায় না। খালগুলো হারানোর সঙ্গে সঙ্গে বর্ষায় বাড়ছে জলাবদ্ধতা।
একটি বড় জলপথ ছিল পান্থপথ খাল। যেটি ধানমন্ডি লেককে হাতিরঝিল লেকের সাথে সংযুক্ত করতো। এখন পান্থপথ রোডের নীচে খালটি চাপা পড়ে গেছে। এটি দিয়ে একসময় বৃষ্টির পানি বেগুনবাি খালে প্রবাহিত হতো। আরেকটি জলাশয় ছিল পরীবাগ খাল। যেটি শাহবাগ থেকে মগবাজার হয়ে প্রবাহিত হতো। এখন এটি সোনারগাঁও সড়কের কারণে হারিয়ে গেছে। একসময়ের প্রধান জলাধার হিসেবে বিবেচিত আরামবাগ ও গোপীবাগ খালও ভরাট হয়ে গেছে। একইভাবে রাজাবাজার ও নন্দীপাড়া-ত্রিমোহিনী খাল বক্স কালভার্টে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
বিশেষ করে একটি দীর্ঘ খাল যা মৎস্য ভবন এলাকা থেকে প্রবাহিত হতো। এটিও কালের পরিক্রমায় সড়কে রূপান্তরিত হয়েছে। কাজলার পাড় খাল একসময় স্থানীয়দের জন্য অত্যাবশ্যকীয় এক জলপথ ছিল। এখন এটি কাজলা-কুতুবখালী সড়কে পরিণত হয়েছে। ধোলাইখাল ও দয়াগঞ্জ খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় ধোলাইখাল-দয়াগঞ্জ-মিরহাজিরবাগ এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। এমনকি কাঁঠালবাগান ও ধলপুর খালও একই পরিণতি পেয়েছে। এই জায়গাগুলি এখন জমি ও অবকাঠামো তৈরি করে দখল করা হয়েছে। রায়েরবাজার, সেগুনবাগিচা, গোবিন্দপুর, কাঁঠালবাগান ও নারিন্দা খালসহ আরও অনেক খাল একই পরিণতির মুখোমুখি হয়েছে। ঢাকা ওয়াসা খালগুলোকে সড়কে রূপান্তরের জন্য সরকারি নির্দেশনা ছিলো বলে জানিয়েছে ঢাকা জেলা প্রশাসন।
ঢাকার খালের ইতিহাস অনুসন্ধানে যে ৪৭টি খালের কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে কল্যাণপুর প্রধান খালের সঙ্গে আরও ছয়টি খাল সংযুক্ত রয়েছে। এছাড়া ইব্রাহিমপুর, আগারগাঁও, শ্যাওড়াপাড়া, মহাখালী, বেগুনবাড়ি, গুলশান, বনানী, কাটাসুর, আব্দুল্লাহপুর, বাউনিয়াবাদ, রূপনগর, দিয়াবাড়ি, শাহজাহানপুর, কাটাসুর, রামচন্দ্রপুর, বাইস ডেকি, হাতিরপুল, পরীবাগ, রাজাবাজার, রায়েরবাজার, মোহাম্মদপুর, হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর, গোপীবাগ, সেগুনবাগিচা, ধোলাইখাল, খিলগাঁও, বাসাবো, ধলপুর, মান্ডা, পান্থপথ, গজারিয়া, দক্ষিণগাঁও, নন্দিপাড়া, সুতিখাল, বাড্ডা, গুলশান, মহাখালী, ধানমন্ডি, মেরাদিয়া ও গজারিয়া খাল। এর মধ্যে অধিকাংশ খালের অস্থিত্ব বিলীন হয়ে গেছে।
কয়েক দফায় ঢাকার খাল উদ্ধার করে ওয়াকওয়ে এবং খালের দুই পাড়ে বাহারি ফুল ও ফলের গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। উদ্ধার অভিযানে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়। এরপর কয়েক মাস যেতে না যেতেই আবারও দখল হয়ে যায় খাল। দখল-দূষণ আর উচ্ছেদের খেলা চলছে বহু বছর ধরে। নগরবিদরা বলছেন-২৬টি খালের কথা বারবার উঠে আসছে। বাকি ২১ খাল কাদের দখলে তা বলা হচ্ছে না। পুরো ৪৭টি খাল উদ্ধার না করলে বিচ্ছিন অভিযানে ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর হবে না-বলছেন নগরবিদরা। শুধু খাল নয়, দখল আর দূষণে ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর অবস্থাও নাজুক। শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু ও বুড়িগঙ্গা এই চার নদী রক্ষায় ২০০৯ সালে হাইকোর্ট খাল ও নদী রক্ষায় ১২ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন।
নদী বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক ড. সালেহ আহমেদ চৌধুরী বলেন, রাজধানীর ৪৭টি খালের মধ্যে এখন টিকে আছে ২৬টি। ঢাকার চারপাশে চারটি নদীকে ঘিরে যে খালগুলো আছে, যেগুলো বিভিন্ন দিকে দখল হয়ে গেছে বা দূষণের কারণে নদীর সঙ্গে যুক্ত হতে পারছে না, সেগুলো উদ্ধার করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনার মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন করা হলে শুধু ঢাকার চারপাশে নৌ-চলাচল নয়, ঢাকার মধ্য দিয়েও নৌ-চলাচল সম্ভব হবে।
এ বিষয়ে নগরপরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী ড. ইমতেয়াজ নাঈম বলেন, সিএস ম্যাপ অনুযায়ী ঢাকাসহ আশুলিয়া, আমিনবাজার, কেরানীগঞ্জ ও সাভারে ৭৭টি খাল চিহ্নিত আছে। আইন অনুযায়ী খাল, নদী ও জলাশয় দেখভাল করবে জেলা প্রশাসক। পাঁচ বছর আগে ওয়াসাকে খাল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওয়াসা পানি নিষ্কাশনের জন্য কিছুটা সচল এমন ২৬টি খাল নিয়ে কাজ করেছে। বাকি খালগুলো তাদের অবহেলায় দূষণ ও দখলে হারিয়ে গেছে। খাল উদ্ধারে রাজনৈতিক শক্তি দরকার। আশা করছি বর্তমান অন্তর্বতী সরকারের সেই শক্তি আছে। পরিবেশ অধিদপ্তর, রাজউক, স্থানীয় সরকার বিভাগ, ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, সড়ক পরিবহণসহ সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বিত উদ্যোগে খাল ও নদী উদ্ধার করা সম্ভব।