Jaijaidin

অমানবিকতার মানবিক সমাধান

Shah Alam Soulav
9 Min Read

মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান

বিশ্ব সভ্যতার আধুনিক যুগে বর্ণবাদের সবচেয়ে খারাপ উদাহরণ হিসেবে দক্ষিণ আফৃকার নাম চলে আসে। ১৯৪৮-১৯৯৪ সাল পর্যন্ত কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের প্রতি শাসক শ্বেতাঙ্গ শ্রেণির এই তীব্র বর্ণবিদ্বেষ অ্যাপারথেইড বা পৃথকীকরণ নামে পরিচিতি। ১৯৪৮ সালে শ্বেতাঙ্গদের ন্যাশনাল পার্টি ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে একই দেশের নাগরিক কৃষ্ণাঙ্গদের আলাদা করার নির্মম উদ্যোগ গ্রহণ করে। অ্যাপারথেইড প্রকল্পের নামে দেশটিতে চারটি বর্ণগোষ্ঠী সৃষ্টি করা হয়। হোয়াইট বা শ্বেতাঙ্গ, ব্ল্যাক বা কৃষ্ণাঙ্গ, ইনডিয়ান বা ভারতীয় এবং কালারড বা তামাটে বর্ণের মানুষ। তখন দেশটির প্রায় ৭০ ভাগই ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক। শ্বেতাঙ্গর সংখ্যা শতকরা ২০ ভাগ।

অ্যাপারথেইড প্রকল্পের নামে সংখ্যাগুরু কৃষ্ণাঙ্গদের সব নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। লাখ লাখ কৃষ্ণাঙ্গকে বাধ্যতামূলকভাবে ঘরছাড়া করা হয়। তাদের শহরের বাইরে নির্ধারিত কাঁটাতারের বেড়ায় ঘেরা এলাকায় থাকতে হতো। কোনো ভোটাধিকার প্রয়োগ বা রাজনীতি করার অধিকার তাদের ছিল না। তারা মূলত শ্রমিক শ্রেণিতে পরিণত হন। রাজধানী বা শ্বেতাঙ্গদের নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে ঢুকতে হলে তাদের বিশেষ অনুমতি নিতে হতো। শ্বেতাঙ্গদের জন্য নির্ধারিত সমুদ্রসৈকত এমনকি পাবলিক টয়লেটও তারা ব্যবহার করতে পারতেন না। তাদের কোনো আইনগত সহায়তা ছিল না। প্রাচীন যুগের গ্রিস বা রোমের দাসশ্রেণির আধুনিক উদাহরণে পরিণত হন দক্ষিণ আফৃকার কালো মানুষরা।

এই অমানবিকতার প্রতিবাদ করতে গিয়ে ২১ হাজার মানুষ মারা যান এবং লাখো মানুষ জেলবন্দি হন। কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে দক্ষিণ আফৃকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা ২৭ বছর জেলবন্দি ছিলেন। কিন্তু তিনি সব সময়ই বিশ্বাস করতেন, কালো মানুষের মুক্তি একদিন আসবেই। তার অসামান্য ধৈর্য্য এবং আত্মত্যাগ পুরো দক্ষিণ আফৃকা শুধু নয়, সারা পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষকেই বর্ণবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে প্রধান ভূমিকা পালন করে।

নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে একসময় শ্বেতাঙ্গ শাসকরা বাধ্য হন সর্ববর্ণের নির্বাচন দিতে। ১৯৯৪ সালে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বাধীন আফৃকান ন্যাশনাল কংগ্রেস বিপুল ভোটে বিজয়ী হলে দক্ষিণ আফৃকার প্রেসিডেন্ট হন ম্যান্ডেলা। নির্বাচিত হয়েই তিনি প্রথম যে উদারতা দেখান, সেটা হলোÑ প্রেসিডেন্ট পদে তারই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী শ্বেতাঙ্গদের প্রতিনিধি ডাবলিউ ডি ক্লার্ককে তিনি তার ডেপুটি প্রেসিডেন্ট মনোনীত করেন। অথচ এই ডি ক্লার্কই শ্বেতাঙ্গ শাসনের শেষ প্রেসিডেন্ট ছিলেন। বিভিন্ন ধরনের সুযোগ থাকার পরও প্রতিহিংসার পথে না গিয়ে রাজনীতি থেকে শুরু করে খেলাধুলাসহ সব ক্ষেত্রে নেলসন ম্যান্ডেলা ঐক্যের অনন্য নজির সৃষ্টি করেন।
নেলসন ম্যান্ডেলার উদ্যোগে ১৯৯৫ সালে দক্ষিণ আফৃকার নতুন পার্লামেন্ট ‘প্রমোশন অফ ন্যাশনাল ইউনিটি অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন অ্যাক্ট’ নামে একটি আইন পাস করে। এর মাধ্যমে ‘দি ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’-টিআরসি গঠন করা হয়। বাংলায় এর অর্থ ‘সত্য ও পুনর্মিলন’ কমিশন। এর প্রধান লক্ষ্য ছিলÑ অপরাধী ও ভুক্তভোগীদের উদ্দেশ্য ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ন্যায়বিচার এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। চলতি বছর এই ট্রুথ কমিশনের ৩০ বছর পালন করা হচ্ছে।

বর্ণবৈষম্যের পুরো সময় অপরাধী ও ভুক্তভোগীর মধ্যে সমন্বয় এবং তাদের মধ্যে আবার ভালো সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়। সব অপরাধীকে গণহারে শাস্তি না দিয়ে প্রধান অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা এবং লঘু অপরাধ স্বীকার করে অল্প দণ্ড অথবা ক্ষমা করার বিধান রাখা হয় এতে। সব বর্ণের মিলনকেও এখানে প্রাধান্য দেয়া হয়।
সর্বজনশ্রদ্ধেয় নোবেলজয়ী আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু এই কমিশনের প্রধান ছিলেন। কমিশনটি তিনটি কমিটি নিয়ে গঠিত হয় : অ্যামনেস্টি কমিটি, পুনর্বাসন কমিটি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন কমিটি।

কমিশন তিনটি প্রধান বিষয় নিয়ে কাজ করে :

১. দক্ষিণ আফৃকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণ ও প্রকৃতি অনুসন্ধান করা।

২. প্রকৃত ভুক্তভোগী খুঁজে বের করে যথাযথ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা।

৩. অপরাধী অপরাধ স্বীকার করলে তাকে ক্ষমা করা এবং তার সম্পৃক্ততার তথ্য প্রকাশ করা।

কমিশন ২১,০০০ ব্যক্তির বক্তব্য গ্রহণ করে, যার বড় অংশই প্রকাশ্য শুনানিতে উপস্থাপন করা হয়। কমিশনের কাছে ১০,০০০ হত্যার অভিযোগসহ মোট ৩৮,০০০টি গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নথিভুক্ত হয়। কমিশন ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তা, প্রতীকী সম্মাননা এবং সম্প্রদায় পুনর্গঠন কার্যক্রম গ্রহণ করে। অপরাধীরা তাদের অপরাধের বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করলে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের ক্ষমা করা হতো। কমিশন ৭,১১২টি ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন পায়। যার মধ্যে ৮৪৯টি কেস গ্রহণ করা হয়। বাকিগুলো বাতিল করা অথবা আবেদনকারীরা তুলে নেন।
কমিশন ক্ষতিপূরণ দেয়ার ক্ষেত্রে সে সময় প্রত্যেক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা পরিবারকে পরবর্তী ছয় বছরের জন্য প্রতিবছর ৩,৫০০ ডলার হারে মোট ২১,০০০ ডলার দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ক্ষতিগ্রস্ত সবার প্রতি আন্তরিক ক্ষমা প্রার্থনা করেন প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা।

এই কাজে অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ, ১৯৯০-১৯৯৪ সালের মধ্যে ব্যাপক সংখ্যক নথিপত্র ধ্বংস করে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা। কমিশন দক্ষিণ আফৃকার ঘটে যাওয়া বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে নিয়ে আসে। এখানে ইতিহাসের অনেক ঘটনাকেও সামনে নিয়ে আসা হয়। এর মাধ্যমে সন্ত্রাসের শেকড় খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়। কমিশন দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে প্রশাসন, বিচার, ব্যবসাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রস্তাব করে।

কমিশনারদের নাম ঘোষণা করা হয় ১৫ ডিসেম্বর ১৯৯৫ তারিখে। এতে আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু চেয়ারপারসন এবং ড. অ্যালেক্স বোরাইন সহ-চেয়ারপারসন ছিলেন। ‘প্রমোশন অফ ন্যাশনাল ইউনিটি অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন অ্যাক্ট’-এর ধারা ৪৬(২)-এর অধীনে কমিশনের জন্য একজন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়। যিনি প্রধান হিসাব কর্মকর্তা হিসেবেও কাজ করেন। ১৭ জন কমিশনার ও ৩০০ জন কর্মী এখানে কাজ করেন। কমিশন সব ধরনের রাজনৈতিক দল, সরকার বা প্রশাসনের প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল। আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠী এবং দেশ যেমনÑ ডেনমার্ক, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রিয়া, নরওয়ে এবং বেলজিয়াম কমিশনকে আর্থিক সহায়তা করে।

এভাবেই ট্রুথ কমিশন দক্ষিণ আফৃকার ইতিহাসে জাতীয় পুনর্মিলনের ক্ষেত্রে কাজ করে। প্রতিষ্ঠার সময় ১৯৯৫ সাল থেকে তিন বছর পর ১৯৯৮ সালে এটি তার মূল ম্যান্ডেট পূরণ করে। অক্টোবর ১৯৯৮ সালে কমিশন তার সম্পূর্ণ রিপোর্ট প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলার কাছে হস্তান্তর করে। তবে ২০০২ সাল পর্যন্ত ট্রুথ কমিশন পুরোপুরি সক্রিয় ছিল। এখনো সংক্ষিপ্ত আকারে এর অস্তিত্ব রয়েছে।

ট্রুথ কমিশন নিয়ে অনেক সমালোচনা থাকলেও একটি তীব্র সংঘাতময় ও বিদ্বেষপূর্ণ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় নেলসন ম্যান্ডেলা ও ডেসমন্ড টুটুর ট্রুথ কমিশন মডেল বিশ্বজুড়ে আলোচিত হয়। ট্রুথ কমিশনের অভিজ্ঞতা নিয়ে এর প্রধান ডেসমন্ড টুটু একটি বই লেখেন ‘নো ফিউচার উইদাউট ফরগিভনেস : এ পারসোনাল ওভারভিউ অফ সাউথ আফৃকা’স ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ শিরোনামে।

ট্রুথ কমিশন ও বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট

২০২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর দক্ষিণ আফৃকার মতো একটি ট্রুথ কমিশন স্থাপনের প্রসঙ্গটি চলে আসে। একটি কর্তৃত্বময় স্বৈরাচারী শাসনে অসংখ্য মানুষের হত্যা, গুম, জেলবন্দি, নির্যাতন, অর্থনৈতিক-সামাজিক নি®েপষণ মিলিয়ে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ছিল সংঘাতময়। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্নভাবে অপরাধীদের বিচার এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করার কথা শোনা গেলেও এখনো কোনো গোছানো উদ্যোগ দেখা যায়নি। প্রকৃত অপরাধীর সঙ্গে আরো অনেকের নাম জড়িয়ে একের পর এক মামলা করে প্রকৃত অপরাধীর অপরাধের গুরুত্ব কমিয়ে দেয়া হচ্ছে এবং মামলা দুর্বল হয়ে পড়ছে বলে অভিজ্ঞ আইনজীবীরাই মন্তব্য করেছেন।

ট্রুথ কমিশনের মতো একটি কমিশন স্থাপন করা হলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ তার অভিযোগ জানানোর একটি প্লাটফরম খুঁজে পেতেন। পাশাপাশি যার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হচ্ছে, তিনিও নিজের দোষ স্বীকার এবং অপরাধের দায় অনুসারে শাস্তি পেতেন। একটি জায়গা থেকেই সব কাজ সম্পন্ন হলে এতে সমন্বয় করা সহজ হতো এবং এটা দ্রুতই সমাধানের পথে যেত। কারণ, যেসব মামলা হচ্ছে, এর সমাধান হতে অনেক সময় চলে যাবে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষিপ্তভাবে করা এসব মামলায় যেমন কোনো সমন্বয় নেই, তেমনি হাজারো অজ্ঞাত আসামির আড়ালে আসল আসামির হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে।

কিউবায় বিপ্লবের পর ফিডেল ক্যাস্ট্রোর বিপ্লবী সরকার খুব অল্প সময়ের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করে ফেলেছিল। গণহারে অভিযুক্তদের না ধরে চিহ্নিত অপরাধীদের দ্রুত শাস্তি দেয়া হয়, যেন পরে দেশ গঠনে এটি আর কোনো প্রভাব না ফেলে। দ্রুততার ক্ষেত্রে দেখা যায়, সম্প্রতি আমেরিকায় নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি নির্বাহী আদেশেই অসংখ্য মানুষকে জেলমুক্ত করেছেন।

ইংরেজিতে একটি কথা প্রচলিত আছে, ‘জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনায়েড।’ বিচার প্রক্রিয়া যত দেরি হবে, ন্যায়বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা ততা কমতে থাকে।

বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী ট্রুথ কমিশন গঠন করার সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি। এরই মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সংস্কার-বিষয়ক কয়েকটি কমিশন তৈরি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সবদিক বিবেচনা করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে একটি ট্রুথ কমিশন তৈরি করার সুযোগ এখনো রয়েছে, যেটা একটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান : সাংবাদিক ও গবেষক

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *