Jaijaidin

সুন্দরবনে হরিণের মাংস ৫০০ টাকা কেজি

Shah Alam Soulav
5 Min Read

আলতাব হোসেন

সুন্দরবনে প্রকাশ্যে ৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে হরিণের মাংস! অবিশ্বাস্য হলেও এমন বেআইনি ঘটনা ঘটে চলেছে। শুধু তাই নয়, পাচার হচ্ছে হরিণসহ অন্য প্রাণীর চামড়া-মাংস। প্রশাসনের ঢিলেঢালা নজরদারি এবং ক্ষেত্রবিশেষে বন বিভাগকর্মীদের যোগসাজশে অবৈধ শিকারি ও পাচারকারী চক্র এ অপকর্ম করে চলেছে বলে অভিযোগ স্থানীয় জনগণ ও বিশিষ্টজনদের। এতে উজাড় হচ্ছে হরিণসহ বন্যপ্রাণী।

জানা গেছে, শুষ্ক মৌসুমের এ সময়টায় সাধারণত সুন্দরবন সংলগ্ন খালের পানি শুকিয়ে যায়। তাই পানি ও খাবারের সন্ধানে বন থেকে লোকালয়ে চলে আসে হরিণের পাল। এদিকে এবার পর্যটকের ঢল নেমেছে সমুদ্র উপকূলবর্তী বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ ফরেস্টে। এই সুযোগটাই নিচ্ছে বন্যপ্রাণী শিকারি ও পাচারকারী চক্র। বনের ঢিলেঢালা নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে কখনো বন বিভাগের কর্মীদের যোগসাজশে প্রকাশ্যে ফাঁদ পেতে বা গুলি করে শিকার করা হচ্ছে বন্যপ্রাণী। মাঝেমধ্যে মাংস-চামড়াসহ অপরাধীরা ধরাও পড়ে। কিন্তু তা সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য বলে জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সুন্দরবন সংলগ্ন স্থানীয় বাজারে গরু ও খাসির মাংসের তুলনায় হরিণের মাংসের দাম কম। খুলনার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর এবং বাগেরহাটের মোংলা ও শরণখোলা এলাকায় বেশি হরিণ শিকার হচ্ছে। কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের আংটিহারা ও জোড়শিং এলাকায় হরিণ শিকারি চক্রের আধিপত্য বেশি। হরিণ পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বজবজা ও খাসিটানা বন টহল ফাঁড়ি এলাকা। এ ছাড়া মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের নয়ানি, হড্ডা, বানিয়াখালী, শেখেরকোনা ও তেঁতুলতলার চর; কয়রা সদর ইউনিয়নের ৪ নম্বর, ৫ নম্বর ও ৬ নম্বর কয়রা; উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের পাথরখালী, কাটকাটা; মহারাজপুর ইউনিয়নের পূর্ব মঠবাড়ী, মঠেরকোনা গ্রামে প্রকাশ্যে বন্যপ্রাণী শিকার চলছে।

দাকোপ উপজেলার ঢাংমারী, খাজুরা, বানীশান্তা, সুতারখালী ও কালাবগি গ্রামের চিহ্নিত হরিণ শিকারিরা রাতে ও দিনে দলবদ্ধভাবে সুন্দরবনে প্রবেশ করে হরিণ শিকার করছে। অনেক সময় তারা বনের ভেতর ভাগা (ছোট ছোট ভাগ) করে হরিণের মাংস বিক্রি করছে।

বাগেরহাটের মোংলার চিলা, জয়মনি, বৈদ্যমারী, কাটাখাল কুল, বাঁশতলা, কাটাখালী; মোরেলগঞ্জের জিউধরা, গুলিশাখালী, সন্ন্যাসী; শরণখোলার ধানসাগর, তাফালবাড়ী, সোনাতলা, পানিরঘাট, রাজাপুর, রসুলপুর ও চালিতাবুনিয়া, সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগরের বেশকিছু গ্রামে হরিণ শিকারিরা দিনে-দুপুরে সুন্দরবন থেকে হরিণ ধরে এনে পাচারকারীদের নৌকায় তুলে দিচ্ছে।

বুধবার সুন্দরবনের সত্যপীরের খাল এলাকায় তিনটি বস্তায় প্রায় ৮০ কেজি হরিণের মাংস উদ্ধার করেন কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনের বনরক্ষীরা। এর আগে ১৯ জানুয়ারি বনের জোংড়া এলাকা থেকে পাঁচ কেজি হরিণের মাংস জব্দ করা হয়। ১৫ জানুয়ারি কাশিবাদ এলাকায় ৮০ কেজি হরিণের মাংস উদ্ধার করেন বনরক্ষীরা। ৭ জানুয়ারি দুপুরে মোংলায় ১১ কেজি হরিণের মাংস উদ্ধার করে কোস্টগার্ড পশ্চিম জোন। ৩ জানুয়ারি কয়রার কালমা বাজারে প্রকাশ্যে বিক্রির সময় ৩৪ কেজি হরিণের মাসংসহ একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। একই দিন মোংলার ফেরিঘাট সংলগ্ন এলাকা থেকে ১১ কেজি হরিণের মাংসসহ ছয়জনকে আটক করে কোস্টগার্ড।

কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের বাসিন্দা শংকর দাস বলেন, পেশাদার হরিণ শিকারিরা গোপনে সুন্দরবনে ঢুকে নাইলনের দড়ির ফাঁদ পেতে রাখে। চলাচলের সময় হরিণ সেই ফাঁদে আটকে যায়। তারপর বনরক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে হরিণের মাংস বিক্রি করা হয়। স্থানীয় পদ্ধতিতে মাংস, চামড়া, মাথাসহ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংরক্ষণ করে পাচার করে অপরাধীরা। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে এজেন্ট-ব্যবসায়ীদের। এই এজেন্টদের মাধ্যমে কখনো অগ্রিম অর্ডারে, আবার কখনো মাংস আনার পর বিক্রি করা হয়। এই চক্রের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে যায় হরিণের মাংস। গরু ও খাসির মাংসের চেয়ে দাম কম হওয়ায় এ মাসের চাহিদা বেড়েছে সুন্দরবনের আশপাশের জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোতে।

এদিকে ক্রেতারাও অনেক সময় প্রতারণা ভেবে হরিণ নিজ চোখে না দেখে মাংস কিনতে চান না। তাই চোরাশিকারিরা জীবন্ত হরিণ লোকালয়ে এনে জবাই করে মাংস বিক্রি করে। এই মাংসের ক্রেতা বিশেষত ধনাঢ্য ব্যক্তিরা। এ ছাড়া বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ কিনে থাকেন। এ ছাড়া হরিণের চামড়া-শিং সৌখিন ব্যক্তিরা সংগ্রহ করে ড্রইংরুম সাজান।

খুলনার সুন্দরবন অ্যাকাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে সুন্দরবনে বাঘ হত্যা কিছুটা কমলেও হরিণ শিকার বেড়েছে। আইন অমান্য করে চিত্রা হরিণ শিকার করছে কয়েকটি চক্র। যে পরিমাণ হরিণের মাংস ও চামড়া আটক হয়, তার থেকে কয়েকগুণ বেশি হরিণ শিকার হয়। মাঝেমধ্যে দু-একটি অভিযানে হরিণের মাংস, চামড়া, মাথা উদ্ধার হলেও মূল চোরা শিকারি ও পাচারকারীরা আটক হয় না।

সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী শুভ্র শচীন বলেন, বনের পাশে যাদের বাড়ি, তারাই বেশি হরিণ শিকারের সঙ্গে যুক্ত। সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জসংলগ্ন গ্রামগুলোয় দেড় শতাধিক শিকারি দল রয়েছে। বিশেষ করে খুলনার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর এবং বাগেরহাটের মোংলা ও শরণখোলার মানুষ বেশি হরিণ শিকার করেন।

খুলনা অঞ্চলের প্রধান বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, মূলত শুষ্ক মৌসুমে সুন্দরবনের খাল ও নদীতে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় লোকালয়ে হরিণের বিচরণ বেড়ে যায়। চোরা শিকারিরা এ সময় তৎপর হয়ে ওঠে। তিনি আরো বলেন, বিচ্ছিন্ন কিছু শিকারের ঘটনা ঘটলেও সেটা আগের তুলনায় অনেক কম। অল্প জনবল দিয়ে এত বড় বনে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খেতে হয় বন বিভাগকে।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *