Jaijaidin

মাছ চাষে সম্ভাবনা দেখছে দেশ

Shah Alam Soulav
6 Min Read

আলতাব হোসেন

‘মাছে ভাতে বাঙালি’ এই প্রবাদটি এখন আর বাংলাদেশের বেলায় প্রযোজ্য নয়। পণ্যমূল্য নিয়ে নাভিশ্বাস ওঠা এই সময়ে প্রতিদিন প্লেটে মাছের দেখা পান না অনেকেই। তবে এই মাছই দেখাচ্ছে আশার আলো। গ্রামীণ অর্থনীতি সচল রাখতে বড় ভূমিকা রাখছে। রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। দেখা দিয়েছে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বিপুল সম্ভাবনা।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের যে তিনটি দেশ মাছ উৎপাদনে সাফল্য দেখিয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। চাষের মাধ্যমে মাছ উৎপাদনে এদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। তবে সমুদ্রের মাছ ধরায় এখনো পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।

এফএও’র দি স্টেট অফ ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচারের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মিঠা পানির মাছ আহরণে চায়নাকে টপকে গেছে বাংলাদেশ। এছাড়া এদেশে বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে। চাষকৃত মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের সামনে রয়েছে ইনডিয়া ও চায়না। ছয় বছর ধরে বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে পঞ্চম অবস্থানে ছিল।

এফএও’র প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বে অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে মাছ আহরণে বাংলাদেশ তৃতীয়, সামুদ্রিক ও উপকূলীয় ক্রাস্টাশিয়ান্স এবং ফিনফিশ উৎপাদনে যথাক্রমে অষ্টম ও একাদশ স্থানে রয়েছে। এছাড়া বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম, তেলাপিয়া উৎপাদনে চতুর্থ ও এশিয়ায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।

বিশ্বের ৫৭টি দেশে বাংলাদেশের মাছ রপ্তানি হয়। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ৪৭ দশমিক ৮৯ লাখ টন মাছ উৎপাদিত হয়। ২০৩০ সালে মৎস্য উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৬৫ লাখ টন এবং ২০৪১ সালে ৮৫ লাখ টন নির্ধারণ করা হয়েছে। উৎপাদিত মাছ যাতে মানবস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। মৎস্য খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের প্রায় দুই কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানায়, বর্তমানে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৪ লাখ নারীসহ ১ কোটি ৯৫ লাখ বা ১২ শতাংশের বেশি মানুষ মৎস্য খাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। মাছ ও চিংড়িসহ অন্যান্য জলজ সম্পদের স্থায়িত্বশীল উৎপাদন বাড়িয়ে দেশের পুষ্টিচাহিদা পূরণ এবং রপ্তানি আয় বৃদ্ধি ও অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে উন্মুক্ত জলাশয়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এ ক্ষেত্র থেকে প্রাপ্ত সুফলের মাধ্যমে দরিদ্র মৎস্যজীবী ও চাষি তথা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন সাধনের লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার।

বর্তমানে দেশের রপ্তানি আয়ের ১ দশমিক ২৪ শতাংশ আসে মৎস্য খাত থেকে। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭৯ হাজার ৮২ টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে আয় হয়েছে ৫ হাজার ৩৯৭ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ২৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মাছ রপ্তানি করে ৪ হাজার ৭৯০ কোটি টাকার বেশি আয় হয়। চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত প্রায় ৭০ হাজার টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে।

এফএও’র পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৭ সাল নাগাদ বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে, তার মধ্যে প্রথম দেশটি হবে বাংলাদেশ। এরপর থাকবে থাইল্যান্ড, ইনডিয়া ও চায়না। বর্তমানে বিশ্বে মাছ উৎপাদনে প্রথম দেশ চায়না, ™ি^তীয় ইনডিয়া আর তৃতীয় মিয়ানমার। মৎস্য গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রতিবেশ ব্যবস্থা মিঠাপানির মাছ চাষের জন্য উপযুক্ত। এখানকার সোয়া দুই লাখ হেক্টর উন্মুক্ত জলাশয় আর গ্রামীণ এলাকায় ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা লাখ লাখ পুকুরে মাছ চাষের যে সম্ভাবনা রয়েছে, তা এখনো পুরোপুরি কাজে লাগানো হয়নি। সরকার যদি মাছ চাষে আরো মনোযোগী হয়, চাষিদের সহায়তা করে, তাহলে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ মাছ উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হতে পারে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ষাটের দশকে আসা তেলাপিয়া দিয়ে শুরু হয় মাছ চাষ বিপ্লব। পরে আসে থাই পাঙাশ, ভিয়েতনামের কই, থাই কই, আফ্রিকান মাগুর। এখন বাজারে পাওয়া ৯০ শতাংশ মাছই চাষের। দেশে বর্তমানে ৪৭৫টি সামুদ্রিক প্রজাতি, ৩৬০টি স্বাদু পানির প্রজাতি, ৩৬টি চিংড়ি প্রজাতির মাছ রয়েছে। বিপন্ন হয়ে যাওয়া ২৪ প্রজাতির মাছ কৃত্রিম প্রজননে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আব্দুল ওয়াহাব আকন্দ বলেন, উন্মুক্ত জলাশয় পুনরুদ্ধার ও মৎস্য অভয়াশ্রম বাড়াতে হবে। দেশি ছোটমাছ রক্ষায় শিল্প-কারখানার দূষণ ও কীটনাশক ব্যবহার কমাতে হবে। ইলিশ মাছের প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা নিষিদ্ধ কর্মসূচি কঠোরভাবে পালন করতে হবে। সমুদ্রসীমা বিজয়ের সুফল ঘরে তুলতে হবে। সামুদ্রিক মাছ আহরণ বাড়াতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশের মাছচাষের বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করেছে।

তথ্যমতে, বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদের উৎস চারটি অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়, বদ্ধ জলাশয়, আধা নোনা পানির জলাশয় ও সামুদ্রিক জলাশয়। মুক্ত এলাকার সঙ্গে যুক্ত জলাশয়কে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয় বলে। এর মধ্যে রয়েছে নদী ও খাঁড়ি অঞ্চল, হাওড়, বিল, হ্রদ ও প্লাবনভূমি। প্লাবনভূমি বর্ষাকালে পানিতে ভরে নদীর সঙ্গে একাকার হয়ে যায় এবং শুকনো মৌসুমে জমিতে পরিণত হয়, তখন সেখানে চাষাবাদ করা হয়। বর্তমানে দেশে মুক্ত জলাশয়ের পরিমাণ ৪০ লাখ ৪৭ হাজার ৩১৬ হেক্টর।

বদ্ধ জলাশয়ের মধ্যে যেগুলো নদী, হাওড় বা বিলের সঙ্গে যুক্ত নয়, তাদের অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয় বলে। অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয়ের মধ্যে রয়েছে পুকুর, দিঘি, বাঁওড় ইত্যাদি। বর্তমানে দেশে বদ্ধ জলাশয়ের পরিমাণ ১ লাখ ৫২ হাজার ৩৭৮ হেক্টর।

সামুদ্রিক জলাশয় সমুদ্রের একান্ত অর্থনৈতিক এলাকা ২০০ নটিক্যাল মাইল এবং মহিসোপান ৮৫ হাজার ১৫৩ বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। দেশের দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। এটি সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের উৎস।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *