Jaijaidin

ভ্যাটের বোঝায় মধ্যবিত্তের মাথায় হাত

Shah Alam Soulav
6 Min Read

এম সাইফুল

মূল্যস্ফীতি নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টার উদ্বেগ প্রকাশের দুই সপ্তাহ না যেতেই মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এতে শতাধিক পণ্য ও সেবার দাম আরেক দফা বাড়ছে। ফলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সূত্রমতে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। যদিও অর্থ উপদেষ্টা নতুন করে ভ্যাট বাড়ানোর কারণে জনজীবনে প্রভাব পড়বে না বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু বাজারে এর প্রভাব পড়েছে।
সাধারণত প্রতিবছর বাজেটের সময় অর্থবিলের মাধ্যমে কর-ভ্যাট বাড়ানো হয়। হঠাৎ করে অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে এমন সিদ্ধান্তে হতবাক সংশ্লিষ্টরা। এমনকি রাজস্ব খাত সংস্কার কমিশনের অনেকেই অবাক হয়েছেন। তবে সরাসরি গণমাধ্যমে বক্তব্য দিতে রাজি হননি সংশ্লিষ্ট কেউ। বরং তারা বলছেন, শুল্ক ও করের হার বাড়াতে বা কমাতে পারবে না এনবিআরÑ এমন একটি সুপারিশ করা হচ্ছে সরকারের কাছে। কারণ এনবিআর রাজস্ব আদায়কারী সংস্থা। রাজস্ব কমানো-বাড়ানোর বিষয়ে কোনো নীতি গ্রহণ করতে পারবে না। রাজস্ব-সংক্রান্ত সব নীতি করবে আলাদা একটি সংস্থা। এর নাম হতে পারে রাজস্ব নীতি কমিশন। বাজেটের অর্থবিলও তৈরি করবে এই সংস্থা।

এদিকে বৃহস্পতিবার ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক সংক্রান্ত দুটি অধ্যাদেশ জারি করেছে এনবিআর। এতে দেখা যায়, মোবাইল ফোনে কথা বলা, হোটেল-রেস্টুরেন্ট সেবা, ইন্টারনেট সেবা, কোমল পানীয়, সিগারেটসহ শতাধিক পণ্য ও সেবায় শুল্ক-কর বাড়ানো হয়েছে।

এই দুটি অধ্যাদেশ জারির পর এনবিআরের ভ্যাট বিভাগ এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করেছে। ফলে এই অধ্যাদেশের পরিবর্তনগুলো সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হয়ে গেছে।

মূল্য বৃদ্ধির তালিকায় আরো যুক্ত হবে মিষ্টি, ওষুধ, এলপি গ্যাস, ফলের রস, ড্রিংক, বিস্কিট, চশমার ফ্রেম, সিগারেটসহ নানা পণ্য। এর আগে ফ্রিজ, এসি ও মোটর সাইকেলের করপোরেট ট্যাক্স বাড়ানোর পর শতাধিক পণ্যের ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ালো সরকার। এতে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার খরচ আরও বেড়ে যেতে পারে। মোবাইল ফোন সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির ফলে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারে খরচ বাড়বে। বাড়বে রেস্টুরেন্টের খাবারের খরচ।
গত ১ জানুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির এনবিআরের প্রস্তাব পাস হয়। আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত সাপেক্ষে প্রধান উপদেষ্টা ও রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর তা অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হয়। জাতীয় সংসদ না থাকায় অধ্যাদেশের মাধ্যমে শুল্ক-কর বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

আগে মোবাইল ফোনের সিম বা রিম কার্ড ব্যবহারের ওপর ২০ শতাংশ হারে সম্পূরক শুল্ক আরোপ হতো। এটি বাড়িয়ে এখন ২৩ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে মুঠোফোনে কথা বলা এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ বাড়বে। ব্র্যান্ডের দোকান ও বিপণি বিতানের তৈরি পোশাকের আউটলেটের বিলের ওপর ভ্যাট সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া সব ধরনের রেস্টুরেন্টের ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।

শুল্ক-কর বৃদ্ধির তালিকায় আরো আছে টিস্যু, সিগারেট, বাদাম, আম, কমলালেবু, আঙুর, আপেল ও নাশপাতি, যে কোনো ধরনের তাজা ফল, রং, ডিটারজেন্ট, মদের বিল, পটেটো ফ্লেক্স, চশমার প্লাস্টিক ও মেটাল ফ্রেম, রিডিং গ্লাস, সানগ্লাস, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার ও তাতে ব্যবহৃত তেল, বিদ্যুতের খুঁটি, সিআর কয়েল, জিআই তার ইত্যাদি। এছাড়া ভ্রমণকরও বাড়ানো হয়েছে।

অভ্যন্তরীণ উড়োজাহাজের আবগারি শুল্ক ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭০০ টাকা করা হয়েছে। সার্কভুক্ত দেশের জন্য এই শুল্ক বাড়িয়ে দ্বিগুণ করে এক হাজার টাকা করা হয়েছে। এশিয়া মহাদেশের দেশে (সার্কভুক্ত দেশ বাদে) ২০০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫০০ টাকা করা হয়েছে। আর এসবের বাইরে অন্যান্য দেশে ৩০০০ টাকার আবগারি শুল্ক ৪০০০ টাকা করা হয়েছে।

নিম্ন-মধ্য, উচ্চ ও অতিউচ্চ সিগারেটের সম্পূরক শুল্ক ৬৭ শতাংশ করা হয়েছে। আগে যা ছিল যথাক্রমে ৬০, ৬৫.৫, ৬৫.৫ ও ৬৫.৫ শতাংশ।

স্থানীয় ব্যবসায় ভ্যাটের হার ৫ থেকে ৭.৫ শতাংশ করা হয়েছে। ওষুধ ব্যবসার ক্ষেত্রে এ হার ২.৪ থেকে ৩ শতাংশ করা হয়েছে।

চলচ্চিত্র প্রদর্শক (প্রেক্ষাগৃহ), চলচ্চিত্র পরিবেশক, মেরামত ও সার্ভিসিং, স্বয়ংক্রিয় ও যন্ত্রচালিত করাতকল, খেলাধুলার আয়োজক, পরিবহন ঠিকাদার, টেইলার্স, ভবন রক্ষণাবেক্ষণ সংস্থা, খেলাধুলার ক্লাব, বোর্ড সভায় যোগদানকারী, মোটর গ্যারাজ, ডকইয়ার্ড, ছাপাখানা, বৈদ্যুতিক খুঁটি, ইলেকট্রিক পোলের ভ্যাট ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।

নন-এসি হোটেল, কিচেন টাওয়াল, টয়লেট টিস্যু, ন্যাপকিন টিস্যু, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, জোগানদার, সানগ্লাস (প্লাস্টিক, মেটাল ফ্রেম), ফ্যাশন হাউজের ভ্যাট ৭.৫ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।

রেস্টুরেন্ট, ইভেন্টিং সংস্থার ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের ট্রান্সফরমার, নারকেল ছোবড়ার ম্যাট্রেস, বিআরটিএ থেকে সরবরাহ করা লেমিনেটেড ড্রাইভিং লাইসেন্সের ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। চাটনি, কেচাপ, হাতে তৈরি বিস্কিট, কেক, আচারের ভ্যাট হার একইভাবে বাড়ানো হয়েছে।

বার ও বারযুক্ত হোটেল-মোটেল সেবায় ভ্যাট হার ২০ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া এলপি গ্যাসে ভ্যাট ৫ থেকে বাড়িয়ে ৭.৫ শতাংশ করা হয়েছে। ইন্টারনেট সেবায় (আইএসপি) ১০ শতাংশ ভ্যাট বসানো হয়েছে।

ফলের রসে ৫ শতাংশ ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। কার্বোনেটেড ও নন-কার্বোনেটেড পানীয়তে যথাক্রমে ৩০ ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানো হয়েছে। বিভিন্ন ফল ও বাদামে ভ্যাট ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। ডিটারজেন্ট ১০ শতাংশ ভ্যাট বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ, সাবানে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বাড়িয়ে ৬০ শতাংশ, পেইন্টস ও বার্নিসে ১০ শতাংশ ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ মুহম্মদ মাহবুব আলী যায়যায়দিন প্রতিদিনকে বলেন, আমি ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর বিষয়টি সরকারের জন্য নেতিবাচক হিসেবে দেখছি না। কারণ এটি আইএমএফের ঋণের শর্তের মধ্যে ছিল। যদি আপনার অভ্যন্তরীণ সম্পদ দিয়ে বাজেট মেটাতে না পারেন। তাহলে বিদেশি ঋণ নিতে হবেই। তাই তাদের সঙ্গে দর কষাকষি করে কিছু দিন আটকে রাখা যায়। বেশি দেরি করা যায় না। তাই আমি সরকারকে বলবো, ভ্যাট বা করের আওতা না বাড়িয়ে ক্ষেত্র বাড়ানো জরুরি। এখনো অনেক খাত আছে যেখানে ভ্যাট-ট্যাক্স দিতে হয় না। সেগুলো সরকারের উচিত খুঁজে বের করা।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *