Jaijaidin

৭ কলেজ এখন সরকারের গলার কাঁটা

Shah Alam Soulav
8 Min Read

শহীদুল ইসলাম সোহাগ

দেশের শিক্ষা খাতকে এগিয়ে নিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বিশেষ ভূমিকা রাখছে সরকারি কলেজগুলো। কিন্তু শিক্ষক স্বল্বতা, ক্লাসরুমের স্বল্বতা আবার আসনের চেয়ে বেশি ছাত্রের ভর্তি। এছাড়াও আবাসন ও সেসশনজটসহ নানা বিধ সমস্যার মধ্যে জরজারিত কলেজগুলো। যারই ফলশ্রুতিতে দেখা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা নিজেদের স্বতন্ত্র আইডেন্টি ও পরিচয়ের জন্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার জন্য রাজপথে তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলে। শুধু তাই-ই নয়, শিক্ষা উপদেষ্টা বলেছেন, এতো অল্প সময়ের মধ্যে সাত কলেজকে নিয়ে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যায় গঠন করা কঠিন হবে। তাহলে এখন প্রশ্ন উঠেছে কি হবে এই সাত কলেজের প্রায় দুই লাখের বেশি শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ। বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার কি পারবে এসবের সমাধান দিতে। তাই শিক্ষা বিশেজ্ঞরা বলছে, এই সাতকলেজ এখন সরকারের গলার কাঁটা।

শুধু তাই-ই না রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। প্রায়ই এমন শিরোনামের সঙ্গে রাজধানীসহ দেশের মানুষ খুব পরিচিত। কথায় কথা শিক্ষার্থীরা রাস্তায় বন্ধ করে কর্মসূচি পালন করে। সর্বশেষ গত রোববার রাতে সেটি সংঘর্ষে জড়ায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক ভিসি আরেফিন সিদ্দিক ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি হারুন-অর রশিদের দ্বন্দ্বে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া সাত কলেজে এখন সরকারের গলার কাঁটা হয়ে দাড়িয়েছে। আর এই সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা গত সাত বছরের কয়েক’শ বার দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। ৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক পট পরিবর্থনের পরও অন্তত অর্ধশতাধিববা রাস্তায় নেমেছে শিক্ষার্থীরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর আরেফিন সিদ্দিকের সঙ্গে তৎকালনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর হারুন-অর-রশিদের পুরানো দ্বন্দ্বের জেড়ে ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি সাতটি পুরানো কলেজকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভূক্ত করা হয়। এটা করার পিছনে যুক্তি ছিল-বিপুল সংখ্যক কলেজ সামলাতে হিমশিম খাওয়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভার কমানো। একই সাথে সময় মত পরীক্ষা নেওয়া ও ফল প্রকাশ করে দীর্ঘ সেশনজট কমানো এবং অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে গতি আনা।

কিন্তু এর নেপথ্যে ছিল আরেফিন-হারুনের পুরানো দ্বন্দ্ব। প্রফেসর হারুন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হওয়ার পর তার ক্ষমতা ও আয়ের উৎসে হাত দিতেই সাত কলেজকে আলাদা প্রস্তাব দেয় ঢাবির তৎকালীন ভিসি আরেফিন সিদ্দিক। সেই প্রস্তাবে তৎকালীন সরকারে সায় মিলে। নানা প্রক্রিয়া শেষে ঢাবির অধিভূক্ত হওয়ার পর থেকেই নতুন নতুন সমস্যা দেখা যায় কলেজগুলোতে।

কলেজ শিক্ষার্থীরা জানান, তারা এখন স্বতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়হীনতায় ভুগছেন। আমরা নিজেদের পরিচয় দিতে গিয়ে নানান সমস্যার সম্মুখীন হই। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে গবেষণার অপ্রতুলতা, বিভাগভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষকের সংকট। সক্ষমতার বাইরে মাত্রাতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করানো, পরীক্ষার ও ফল প্রকাশের বিলম্বের কারণে আন্দোলন লেগেই থাকতো। সর্বশেষ ৫ আগস্টের পর ক্ষমতায় পালাবদলের পর শিক্ষার্থীরা এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন করছেন। এসব সমস্যা সমাধানে ইতোমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে উচ্চ পযায়ে একটি কমিটি করা হয়েছে।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘আমার-হারুনের দ্বন্দ্বে সাত কলেজ ঢাবির অধিভূক্ত হয়েছিল বিষয়টি সত্য নয়। এই কলেজগুলোর শিক্ষা ও পরিচালনা ব্যবস্থাপনা আধুনিকীকরণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নেতৃত্বে বিভিন্ন সময় কমপক্ষে দুটো কমিটি গঠিত হয়। তাদের পর্যবেক্ষণ ও মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত এ অধিভুক্তির পেছনের কারণ ছিল। এখন সেগুলো হচ্ছে সেটি নিয়ে আমি মন্তব্য করতে চায় না।’

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর হারুন-অর-রশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘এ সমস্যার পিছনে মূল দায় শেখ হাসিনা ও সাবেক দুইজন উপচাযের। তাদের অবিবেচনা প্রসূত সিদ্ধান্তের কারণে সাত কলেজের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভুগছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে আগামী শিক্ষাবর্ষ সাত কলেজে ভর্তি না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে গঠিত কমিটির সুপারিশ পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

গত ২৬ জানুয়ারি রাতে প্রায় সাত কলেজ ও ঢাবি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪ ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষ এবং ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। আর এই সংকটের জন্য আরেফিন সিদ্দিক-ড. হারুনের ব্যক্তিগত রেষারেষিকে দায়ী করেন।

এক সময় দেশের সব ডিগ্রি কলেজ পরিচালিত হতো ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। ১৯৯২ সালে সরকারি কলেজগুলোকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করে তৎকালীন বিএনপি সরকার। এরপর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিধি বাড়তে থাকে। বিপুল সংখ্যক কলেজ সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে। সময় মত পরীক্ষা নেওয়া বা ফল প্রকাশ করতে না পারায় দেখা দেয় দীর্ঘ সেশনজট। অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে দেখা দেয় স্থবিরতা। সনদের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠায় সরকারি বেসরকারি চাকরিতে বৈষম্যের অভিযোগ তুলে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামে। ঠিক ওই সময় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে নিয়োগ পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিকের চির প্রতিদ্বন্দ্বি প্রফেসর হারুন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাত কলেজে নিয়মিত অনিয়মিত প্রায় ২ লাখের বেশি শিক্ষার্থী পড়াশুনা করে। সাত কলেজের আয় থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের এফডিআর করে সেখান থেকে কোটি কোটি টাকা আয় করতো। সাত কলেজকে আলাদা করতে পারলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েল আয় কমার পাশাপাশি ক্ষমতা কমে আসবে সেই চিন্তা থেকে সাত কলেজকে আলাদা করান আরেফিন।

শুরুতেই সমন্বয়হীন

অধিভূক্তির পর সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের তথ্য না দিয়ে অসহযোগিতা শূরু করে জাতীয় বিশ্ববিদালয়। প্রথমে সাতটি কলেজের চারটি বর্ষের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য চারটি সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ করেও শিক্ষার্থীদের সব তথ্য না পাওয়ায় তাঁদের রেজিস্ট্রেশন, ফরম পূরণ, ভর্তিসহ বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। তথ্য চেয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে চারবার ও কলেজগুলোকে দুবার চিঠি পাঠিয়েছে তথ্য পায়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়-ইউজিসির মধ্যস্থতা সেই সমস্যার সমাধান হয়। এরপর প্রায় সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের মাঠে নামানোর হতো বিভিন্ন দাবিতে। এসব পিছনে ছিল হারুনের হাত এমন অভিযোগ সব সময় করেছে ঢাকা বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয়।

৫ আগস্টের পর নতুন সংকট

এতদিন শিক্ষার্থীরা দ্রুত পরীক্ষা ও ফল প্রকাশ, সনদ থেকে ঢাবির ইুস্য করা সনদ থেকে এফিলেডেট বাদ দেওয়ার দাবি জানালেও ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর সাত কলেজের জন্য স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়। এই দাবি প্রথমে তিতুমীর কলেজ করলেও এখন সাত কলেজে সবাই এ দাবি করছে। ইতোমধ্যে তিতুমীরের কিছু শিক্ষার্থী তিতুমীর কলেজ থেকে তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যানার টানিয়েছে। শুধু তাই নয় আগস্ট থেকে বিভিন্ন দাবিতে অর্ধশতাধিক বার রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলন করেছে শিক্ষার্থীরা।

মন্ত্রণালয়-ইউজিসির উচ্চ পযায়ে কমিটি

শিক্ষার্থীদের এমন দাবি প্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে সভাপতি করে ১৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটি প্রত্যাখান করে সাত কলেজ শিক্ষার্থীরা শার্টডাউন কর্মসূচি শূরু কর সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। এরপর স্বতন্ত্র পরিচয় প্রতিষ্ঠায় দিতে গত ২৯ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজকে সভাপতি করে চার সদস্যের উচ্চপর্যায়ের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কমিটিতে মন্ত্রণালয়, ইউজিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসিকে রাখা হয়। আগামী এপ্রিলের মধ্যে কাজ শেষ করতে বলা হয়েছে। কমিটির সাচিবিক দায়িত্ব পালন করছেন ইউজিসির সচিব ড. মো. ফখরুল ইসলাম। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সাত কলেজকে একটি স্বতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর রূপরেখা প্রণয়নে কমিটি সাত কলেজ অধ্যক্ষ, সিনিয়র শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের সাথে দফায় দফায় বৈঠক করেছে। সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষার্থী এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সকলের সঙ্গে আলোচনা করে যেটা মঙ্গলজনক হবে সেই সুপারিশ দ্রুত সময়ের মধ্যে করবে বলে জানান তিনি।’

 

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *