রূপগঞ্জ প্রতিনিধি
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত এ শাহী মসজিদ। মসজিদটি নিয়ে রয়েছে অনেক কল্পকাহিনিও।
কারুকার্য ও নির্মাণশৈলী বিবেচনায় মোগল স্থাপত্যের স্মৃতিচিহ্ন মুড়াপাড়ার শাহী মসজিদ। প্রায় সাড়ে ৫০০ বছরের পুরনো এই মসজিদটির স্থাপত্যরীতিতে মোগল ভাবধারার ছাপও রয়েছে সুস্পষ্ট। অথচ সংস্কারের অজুহাতে ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এ শাহী মসজিদে আধুনিকতার ঘা পড়ছে। অপরিকল্পিতভাবে কাজ করায় সৌন্দর্য হারাচ্ছে স্থাপনাটি।
একপর্যায়ে জৌনপুরের শাসনকর্তা মাহমুদ শর্কী ও দেহরক্ষী বাসুদেব বসুকে নিয়ে বরবক শাহ তার রাজ্য গৌড়ে ফিরে যান। এরপর ১৪৭৪ খ্রিস্টাব্দে বরবক শাহ পরলোক গমন করেন। পরে জৌনপুরের মাহমুদ শর্কী ও দেহরক্ষী বাসুদেব বসুর মুখে পিতার মসজিদের অসমাপ্ত কাজের বর্ণনা শুনে বরবক শাহের পুত্র সামসুদ্দিন আবু মুজাফফর ইউসুফ শাহ মসজিদটির নির্মাণ কাজ শেষ করার তাগিদ দেন। ১৪৭৭ খ্রিস্টাব্দে ইউসুফ শাহ দেহরক্ষী বাসুদেব বসুকে সঙ্গে নিয়ে আছিয়া খাতুনের পরগনায় ফেরেন। এসময় তিনি পৃষ্ঠপোষকদের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত মসজিদ নির্মাণের কাজ শেষ করার তাগিদ দেন।
নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর বরবক শাহের নামানুসারে মসজিদটির নামকরণ করা হয় শাহী মসজিদ। একপর্যায়ে পরগনার ১৮ বিঘা জমি মসজিদের নামে দিয়ে দেয়া হয়। এসময় মসজিদের দায়িত্বভার আমীর জয়েনউদ্দিন হারাভী, আমীর শিহাবউদ্দিন ও মনসুর সিরাজীকে বুঝিয়ে দিয়ে ইউসুফ শাহ পৃষ্ঠপোষক বাসুদেব বসুকে নিয়ে তার রাজ্য ওড়িশায় ফিরে যান।
শাহী মসজিদের পাশে রয়েছে পাঁচটি কবর। এলাকার কয়েকজন বর্ষীয়ান মুরুব্বি বলেন, এখানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন পরগনার মালিক আছিয়া খাতুন, মুসলমান সাহিত্যিক আমীর জয়েনউদ্দিন হারাভী, আমীর শিহাবউদ্দিন ও মনসুর সিরাজী। আরেকজন শমসের মিয়া নামে এক পথচারী।
জানা যায়, মোগল আমলের পতনের পরে ১৮৮৬ সালে ইংরেজ শাসনামলে তৎকালীন জমিদার জগদীশচন্দ্র বসু এ মসজিদটি মাটি দিয়ে ঢেকে ফেলেন। পরে এর পাশে জমিদাররা হিন্দুদের কালীমন্দির তৈরি করেন। একপর্যায়ে মসজিদটি জঙ্গল দিয়ে ঢেকে যায়। এর চিহ্ন পর্যন্ত দেখা যায়নি। ১৯২৫ সালের দিকে সাত ফুট উচ্চতাসম্পন্ন শমসের মিয়া নামে এক পথচারী এক দিন এর পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। এসময় তিনি পাশ থেকে সুমধুর কণ্ঠে কোরআন তেলওয়াত ও আজানের গায়েবী ধ্বনি শুনতে পেয়ে থমকে দাঁড়ান। এনিয়ে তার কৌতূহলও বেড়ে যায়। এক দিন তিনি জঙ্গল পরিষ্কার করে ও মাটি খোদাই করতে শুরু করেন। পরে গম্বুজ দেখতে পেয়ে আশপাশের লোকজনকে ডেকে আনেন। কিন্তু তখন জমিদারদের ভয়ে অনেকেই এগিয়ে আসার সাহস পায়নি। পরে শমসের মিয়া স্থানটি পরিষ্কার করে মিনারে দাঁড়িয়ে আজান দেন। এসময় জমিদারদের নির্দেশে পাইক-পেয়াদারা তাকে গুলি করে হত্যা করে। পরে শমসের মিয়াকে পরগনার মালিক আছিয়া খাতুন ও মুসলমান তিন সাহিত্যিকের পাশেই দাফন করা হয়।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, বর্গাকার মসজিদটির দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ৪০ ফুট করে। চারপাশের দেয়াল ছয় ফুট আট ইঞ্চি চওড়া। পূর্বপাশে রয়েছে খিলান আকৃতির প্রবেশপথ। এই ইটের দৈর্ঘ্য ১২ ইঞ্চি, প্রস্থ ১০ ইঞ্চি এবং চওড়া ২ ইঞ্চি। বর্তমান যুগের ইটের চেয়ে এর আকৃতি একেবারেই আলাদা। মসজিদের গম্বুজ খাঁজকাটা। গম্বুজের চূড়া গোলাকার ও সুঁচালো। খিলানের চারপাশ লতাপাতার কারুকাজ।
তবে ঐতিহ্যের সাক্ষী হিসেবে টিকে থাকা এই শৈল্পিক স্থাপনার শরীরজুড়ে এখন শুধুই অযত্ন আর অবহেলার ছাপ। এখন পর্যন্ত প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কারও পা পড়েনি এই স্থাপনায়। লোক ধারণক্ষমতা বাড়াতে এলোমেলো কাজ করে খর্ব করা হয়েছে মসজিদটির সৌন্দর্য।
মসজিদের সামনেই কথা হয় ৬২ বছরের মুসল্লি শরীফ মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার দাদার মুহে হুনছি এই মসজিদের কথা। মসজিদ নিয়া অনেক যুদ্ধও অইছে দাদা কইতো।’
রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘মসজিদটির বিষয়ে আমার জানা নেই। যদি ঐতিহ্যবাহী মসজিদ হয়ে থাকে এটি, তবে স্মৃতি হিসেবে ধরে রাখা উচিত। আমি খোঁজ নিয়ে দেখব।