সোনারগাঁ (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি
অন্ধকারে জোনাকির মতো হারিকেনের মিটমিট আলোয় কাঁচাপাকা রাস্তা দিয়ে একেবেঁকে চলা প্যাডেলের রিকশার কথা কি মনে পড়ে? দু’পায়ে মারতে মারতে পরিশ্রান্ত চালক চলার মধ্যেই ঝিরিয়ে নিত। নতুন রিকশার দৃষ্টিনন্দন চিত্রকর্ম সকলের মন কেড়ে নিতো।
বর্তমানে রিকশার শহরে মোটামুটি সংগ্রাম করেই টিকে আছে কিছু রিকশা। আর টিকে আছে বলেই টিকে আছে চিত্রশিল্পের অনন্য সাধারণ একটি ধারা, যা রিক্সা পেইন্টিং নামে স্বতন্ত্র পরিচিতি ও মর্যাদা লাভ করেছে।
একাডেমিক চর্চার বাইরে শুধুমাত্র দেখে দেখে শিখেছে এমন একদল শিল্পী দক্ষ হাতে ছবি আঁকেন। এরই ধারাবাহিকতায় নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার সেনপাড়া গ্রামের এসএ মালেক, বংশ পরম্পরায় কাজ শিখে পুরান ঢাকায় অনেক বছর ধরে বিশেষ ধারাটি নিয়ে কাজ করছেন। সিনেমার ব্যানারে এনেছেন বৈচিত্র।
তখনকার বেবিট্যাক্সি ও রিকশাকে চলমান শিল্পকর্ম হিসেবে গড়ে দিতেন। ২০০৪ সাল থেকে ডিজিটাল ব্যানার এ জায়গাটি দখলে নিলে চাহিদা কমে এ শিল্পীদের। তবে বাবা এসএ হাকিমের হাত ধরে তিনি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন।
এসএ মালেক বুলবুল একাডেমী অব ফাইন আর্টস থেকে ৫ বছর মেয়াদি কোর্সে ফাস্ট ক্লাসে উত্তীর্ণ হন। ১৯৮৬ সালে তিনি ইটালিয়ান এম্বাসেডরের কিছু কাজ করে তাদের নজরে পড়েন। তার থেকে তিনি ক্রিসমাস বাজার এবং ক্রাফট ফেয়ার, ব্রিটিশ হাই কমিশন, অস্টেলিয়ান হাই কমিশন ক্লাব, আমেরিকান এম্বাসি, আমেরিকান ইন্টারনেশনাল স্কুল, আমেরিকান ক্লাবে এবং বিভিন্ন উৎসবগুলোতে নিয়মিত চিত্রকর্মের কাজ করছেন।
১৯৯৯ সালে আলিয়ান্স ফ্রাঞ্চাইজ ডি ঢাকাতে ফ্রান্স লেসনের উদ্যোগে “রিকশা এন্ড বেবি টেক্সি পেন্টিংস অব বাংলাদেশ” অংশগ্রহণ করেন। ২০০০ সালে ৫০ বছর ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানি, ঢাকাতে বাংলাদেশের রিকশা চিত্রকলা ক্যালেন্ডারের জন্য ৪৫ জন শিল্পীর চিত্রকর্ম থেকে ১৩ টি চিত্রকর্ম বাছাই করেন। সেখানে এসএ মালেকের মার্সেটিজ গাড়ি এবং লুপথেমসা প্লেন নিয়ে আঁকা ২ টি চিত্রকর্ম নির্বাচিত হয়। ২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ান হাই-কমিশন ক্লাবে তার ২০০ টি চিত্রকর্ম নিয়ে তার একক রিক্সা চিত্রকর্ম প্রদর্শনী হয়। তারপর ২০১৪ সালে একটি স্পেশিয়াল গ্রুপ আর্ট এক্সাবিশন “দেশজ স্পন্দন-২” তে ১২ জন শিল্পির ৬০ টি চিত্রকর্মের মধ্যে “বাংলার মৎস কন্যা” শিরোনামে একটি ছবি স্থান পায়। এছাড়াও দর্পন আর্ট ফাউন্ডেশন কর্তৃক আয়োজিত ২০১৪ ও ২০১৭ সালে “অ্যামেচার আর্ট কনভেনশন” অংশগ্রহণ বিশেষ সম্মাননা পুরস্কারে ভূষিত হন।
এসএ মালেক জানান, একক প্রদর্শনী হলেও, বেশ কিছু কাজ এতে উপস্থাপন করেছি। পুরো গ্যালারি জুড়েই ছিল আমার ২০০টি রিকশাচিত্র। দেখে যারপর নাই অভিভূত হতে হয়েছে। নতুন করে দেখতে হয়েছে। প্রদর্শনীটির মধ্য দিয়ে আবারও সামনে এলো রিকশা পেইন্টিং। ঐতিহ্যের অংশ হয়ে ওঠা এই ধারার কাজ বাঁচিয়ে রাখার সংরক্ষণের দাবি উঠল। চলমান রিকশার গায়ে যে ধরনের চিত্রকর্ম সচরাচর দেখা যায়, এসএ মালেক মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো আঁকড়ে ধরে নতুন কিছু করে দেখানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
লোকজ মেলায় তার স্টলে গিয়ে দেখা যায়, জুলাই-আগষ্টের শহীদ মুগ্ধ ও আবু সাইদকে তুলির আঁচড়ে জীবন্ত করে আনছেন। তিনি মনোযোগ সহকারে চিত্রাঙ্কন করছেন। তার স্টল এনামেল পেইন্ট দিয়ে সাজানো টিনের পাত। পেন্সিল স্কেচ করেছিলেন কাগজে। মিনিয়েচার শিল্পকর্ম হিসেবে প্রদর্শনীতে রাখা হয় শিল্পীর গড়া রিকশা ও বেবিট্যাক্সি। ষাটের দশকে বাঙালীর বিনোদনের প্রধানতম মাধ্যম ছিল সিনেমা। প্রিয় নায়ক নায়িকাদের ছবি সংবলিত পোস্টার ক্যালেন্ডার ঘরে ঘরে শোভা পেত এবং এই সিনেমাকেই বিপুলভাবে আশ্রয় করতেন রিক্সাচিত্রীরা।
বর্তমানে বাংলা সিনেমা নিয়ে আবেগ কমে শূন্যের কোটায় পৌঁছালেও এসএ মালেক আশির দশকে নিজেকে নিয়ে যান। সেখান থেকে উজ্জ্বল স্মৃতি কুড়িয়ে নিয়ে ততোধিক গাঢ় রঙে আঁকেন। লোকায়ত জীবন, ধর্ম বিশ্বাস ও ভাবনা দ্বারা যথারীতি প্রভাবিত হতে দেখা যায় শিল্পীকে। চারপাশের পৃথিবী ও কল্পনার রাজ্য ঘুরে অনুষঙ্গ খুঁজে নেন তিনি। নিজের মতো করে সাজান। শিল্পীর আঁকা ছবিতে পশু পাখি মাছ গাছ নদী ফুল কী নেই? আবহমান গ্রাম বাংলার রূপ রিক্সাচিত্রের নিজস্ব ভাষায় উপস্থাপিত হয়। উজ্জ্বল রং আর রেখার ব্যবহারে অন্য সব আঁকাআঁকি থেকে আলাদা হয়ে ওঠে এসএ মালেকের ছবি। বিভিন্ন পোস্টারে ব্যানারে পত্রিকার পাতায় ছাপা হওয়া ছবিগুলোকে সামনে রেখেই নিজের মতো করে গড়ে নেন তিনি। শিল্পভাষা দেন। এই শিল্পভাষা যেমন মুগ্ধ করে, তেমনি টিকে থাকার আকুতি জানায়!