আলতাব হোসেন
সব বাধার দেয়াল ভেঙে লাল-সবুজের পতাকা হাতে দেশ ভ্রমণে বিশ্বজয়ের রেকর্ড গড়ার পথে বাঙালি নারী নাজমুন নাহার। ঐতিহাসিক বিশ্বভ্রমণের রেকর্ড ছুঁয়েছেন তিনি। এগিয়ে চলেছেন একাই পুরো বিশ্বজয়ের পথে।
বাংলাদেশের পতাকা হাতে সাহারার তপ্ত মরুভূমি থেকে সমুদ্রের তলদেশ, পর্বতশৃঙ্গ, শহর, বন্দর, আফৃকার দুর্গম জঙ্গল সব জায়গায় তার পদচিহ্ন পড়ছে। এই চ্যালেঞ্জিং ভ্রমণে নাজমুনকে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছে বহুবার, হয়েছেন অসংখ্য বাধার সম্মুখীন; কিন্তু পিছিয়ে যাননি। হিংস্র বন্যপ্রাণী ভরা জঙ্গলে রাত কাটিয়েছেন, কাঁচা মাংস খেয়ে বাঁচিয়েছেন জীবন।
চলতি বছর পাপুয়া নিউগিনিতে গিয়ে ১৭৮তম দেশ ভ্রমণের রেকর্ড গড়েন নাজমুন। তার ভ্রমণের বাকি আছে বিশ্বের আর মাত্র ২৩টি দেশ। এগুলো ভ্রমণ হলেই তিনি বিশ্বের প্রথম পতাকাবাহী মুসলমান নারী ও প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিরল গৌরবের অধিকারী হবেন। দীর্ঘ ২৫ বছর পর তিনি এখন তার স্বপ্ন পূরণের দ্বারপ্রান্তে।
পৃথিবীর অনেক দেশের সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন নাজমুন। অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা অভিনন্দন জানিয়েছেন তাকে। গেস্ট স্পিকার হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছেন দেশ-বিদেশে। বিশ্বভ্রমণের অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিচ্ছেন তরুণদের মধ্যে। ৫৬টি অ্যাওয়ার্ড ও সম্মাননা লাভ করেছেন নাজমুন। এর মধ্যে আমেরিকার পিস টর্চ বিয়ারার সম্মাননা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেটি মাদার তেরেসা, গর্বাচেভের মতো ব্যক্তিরা লাভ করেছিলেন। জাম্বিয়া সরকারের গভর্নরের কাছ থেকে পেয়েছেন ফ্ল্যাগ গার্ল উপাধি, সেন্ট লুসিয়ার প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন ব্রেভ গার্ল উপাধি।
নাজমুন নাহারের বিশ্বভ্রমণ শুরু হয় ২০০০ সালে ইনডিয়া ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভেঞ্চার প্রগ্রামে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। ২০০৬ সালে শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে তিনি পাড়ি দেন সুইডেনে। সেখানে পড়াশোনা আর ঘুমের বাইরে যেটুকু সময় থাকত, একটি মুহূর্তও তিনি নষ্ট করতেন না। কঠিন পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করতেন। কখনো ১৭-১৮ ঘণ্টা কাজ করেছেন। প্রতি সামারে টানা তিন মাস কাজ করতেন তিনি। সেই অর্থ জমাতেন ভ্রমণের জন্য।
সেখানে ভ্রমণের জন্য প্রথম বেছে নেন ফিনল্যান্ডকে। বহুতল জাহাজে করে সুইডেন থেকে ফিনল্যান্ড পর্যন্ত পুরোটাই ছিল বিস্ময়কর অভিযাত্রা। এভাবে জাহাজে করে তিনি ফিনল্যান্ড থেকে যান রাশিয়া, এস্তোনিয়া ও লাটভিয়ায়। এরপর ভ্রমণ করেন জার্মানি, ইটালি, ফ্রান্স, সুইটজারল্যান্ড এবং স্পেন, সাহারা মরুভূমি, মৌরিতানিয়া। এরপর সার্বিয়া থেকে আলবেনিয়া, মেসিডনিয়া, স্লোভেনিয়া, স্লোভাকিয়া, ক্রোয়েশিয়া পর্যন্ত ভ্রমণ করেন নাজমুন। এরই মধ্যে পুরো ইওরোপ ভ্রমণ সম্পন্ন করেছেন তিনি।
পরে পূর্ব আফৃকা, পশ্চিম আফৃকা, ওশেনিয়া, সাউথ আমেরিকা ইত্যাদি অঞ্চল ভাগ করে ভ্রমণ করেন নাজমুন। কখনো ১০টি দেশ, কখনো ১২টি দেশ, কখনো ১৫টি দেশ একই সময় ভ্রমণ করেন তিনি। সড়কপথে ভ্রমণ করার উদ্দেশ্য ছিল বাজেট ট্রাভেল এবং পথে পথে অধিকাংশ শহর, নগর, গ্রাম, প্রাকৃতিক অঞ্চল ও মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবন দেখা।
২০১৭ সালে দক্ষিণ আমেরিকার কলাম্বিয়া থেকে ব্রাজিলের আমাজন পর্যন্ত চার মাসে ১১ দেশ ভ্রমণ করেন। ২০১৮ সালে তিনি চার মাসে পশ্চিম আফৃকার মৌরিতানিয়া থেকে নাইজেরিয়া পর্যন্ত ১৫টি দেশ ভ্রমণ করেন। একই বছর তিন মাসে পূর্ব আফৃকার ইথিওপিয়া থেকে মোজাম্বিক পর্যন্ত ১২টি দেশ ভ্রমণ করেন এই অকুতোভয় নারী। নাজমুন তার মাকে নিয়েও ঘুরেছেন ইওরোপ ও আমেরিকার ১৪টি দেশ।
ফ্ল্যাগ গার্ল খ্যাত নাজমুন নাহার বলেন, লাল-সবুজের পতাকাকে নিয়েছি ১৭৮ দেশের সর্বোচ্চ উচ্চতায়। তিনি বলেন, আমি নিজের উপার্জনের টাকা দিয়ে দেশ ভ্রমণ করি। ঘুরতে খুব সামান্য টাকাই লাগে। আসল প্রয়োজন হচ্ছে ইচ্ছা, ধ্যান, প্রার্থনা ও সাধনা। কম খরচে ভ্রমণ করার জন্য আমি বিভিন্ন দেশের স্থানীয় মানুষের পরিবারের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করি।
নাজমুন বলেন, বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা আমার কাছে সবচেয়ে বড় শক্তি। এই পতাকা আমাকে ছায়া দিয়েছে। বাংলাদেশের পতাকা বহন করার জন্য আমি সব কষ্টকে মাথা পেতে নিয়েছি। বাংলাদেশের পতাকা হাতে যখনই আমি নতুন কোনো দেশের সীমান্তে পা দিয়েছি, তখনই আমার সঙ্গে যেন জেগে উঠেছে ১৮ কোটি বাংলাদেশির প্রাণ।
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নারী পরিব্রাজক নাজমুনের জন্ম ১৯৭৯ সালের ১২ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর কিছুদিন সাংবাদিকতা করেন। ২০০৬ সালে শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনার জন্য যান সুইডেন। সেখানে লুন্ড ইউনিভার্সিটিতে এশিয়ান স্টাডিজ বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ‘হিউমান রাইটস অ্যান্ড এশিয়া’ বিষয়ে স্কলারশিপ পেয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন। ফ্ল্যাগ গার্ল খ্যাত নাজমুন নাহার এখনো অবিবাহিত।