Jaijaidin

রেমিটান্সে চাঙ্গা গ্রামীণ অর্থনীতি

Shah Alam Soulav
8 Min Read

আলতাব হোসেন

উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। দেশের পটপরিবর্তনের পর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে প্রবাসী আয়ে, রেকর্ড ভাঙছে প্রতি মাসেই। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী আয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

প্রতিবারই ঈদের সময় প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বেড়ে যায়। এবার ঈদ ঘিরে প্রবাসী আয়ে রেকর্ড হয়েছে। প্রবাসী এই আয় যাচ্ছে গ্রামগঞ্জে। এতে গ্রামীণ আর্থিক কর্মকাণ্ড বাড়ছে। এর সঙ্গে সম্প্রতি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাওয়ায় অর্থ প্রবাহ বাড়ছে। এ ছাড়া সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে কৃষকের ঘরে উঠবে প্রধান ফসল বোরো ধান, যা থেকে মোট খাদ্যের ৬০ শতাংশ জোগান আসে। সার্বিক দিক বিশ্লেষণে বলা যায়, এখন চাঙ্গা গ্রামীণ অর্থনীতি। এতে আগামীতে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি বাড়বে বলে আশা করছেন অর্থনীতিবিদরা।

সাধারণত ঈদের আগে ও পরে চাঙ্গা থাকে গ্রামীণ অর্থনীতি। গ্রাম থেকে উপজেলা বা বড় শহরের বাজারে টাকার প্রবাহ বেড়ে যায়। অর্থের বড় জোগান আসে সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের বোনাস, গতিশীল অভ্যন্তরীণ বাজার, জাকাত ও ফিতরা থেকে। জাকাত ও ফিতরার ৭০ হাজার কোটি টাকা, তৈরি পোশাকের ৩৫ হাজার কোটি, ভোগ্যপণ্যের বাজার থেকে ২৫ হাজার কোটি এবং ঈদ বোনাস, পরিবহন ও অন্যান্য মিলিয়ে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা সরাসরি ঈদকেন্দ্রিক লেনদেন হয় গ্রামে। এ ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ২৭ হাজার কোটি টাকার কিছু অংশ ঈদকেন্দ্রিক ব্যয় হয়। এ অর্থের অন্যতম একটি উৎস রেমিটান্স।

এরই মধ্যে রাজনৈতিক নেতা, চেয়ারম্যান, মেম্বাররা গ্রামের হাটবাজারে মিটিং-মিছিল ও গণসংযোগ করা শুরু করেছেন। ঈদ শুভেচ্ছায় তারা কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছেন। এসব নেতাকর্মীর ঈদ শুভেচ্ছার ডিজিটাল ব্যানার, পোস্টার, বোর্ড গুরুত্বপূর্ণ স্থানে টাঙানো হয়। আবার অনেক নতুন মুখ রাজনীতিতে পরিচিত হওয়ার জন্য ঈদ শুভেচ্ছায় অঢেল টাকা ব্যয় করেন। এ ছাড়া মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য গরিব, দুস্থ, এতিমদের পাশে দাড়ান তারা। বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা, জাকাতের কাপড় বিতরণের ধুম পড়ে যায়। এতে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে ওঠে।

গত বছর আগস্টের শুরুতে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে প্রবাসীরা রেমিটান্স পাঠানো বাড়াতে থাকেন। ওই মাসে ২২২ কোটি ৪১ লাখ ৫০ হাজার ডলার আসে। পরের মাস সেপ্টেম্বরে আসে ২৪০ কোটি ৪৭ লাখ ৯০ হাজার ডলার, অক্টোবরে ২৩৯ কোটি ৫০ লাখ ৮০ হাজার ডলার, নভেম্বরে ২১৯ কোটি ৯৯ লাখ ৯০ হাজার ডলার এবং ডিসেম্বর ২৬৩ কোটি ৮৭ লাখ ৮০ হাজার ডলার। ডলারের দামে স্থিতিশীলতা ও হুন্ডির চাহিদা কমায় বৈধ পথে প্রবাসী আয় বেড়েছে বলে মনে করেন ব্যাংকার ও বিশ্লেষকরা।

আগস্টের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে রেমিটান্সের পরিমাণ। মার্চ মাসের ২৬ দিনে প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ২৯৪ কোটি ডলারের বেশি, যা একক মাস হিসেবে এ যাবতকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ডিসেম্বরে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ (প্রায় ২৬৪ কোটি ডলার) রেমিটান্স আসে। আর দ্বিতীয় সর্বেচ্চ রেমিটান্স বা প্রবাসী আয় আসে ফেব্রুয়ারিতে (প্রায় ২৫৩ কোটি ডলার)। জানুয়ারি মাসে এসেছে ২১৮ কোটি ৫২ লাখ ৩০ হাজার ডলার। প্রবাসী আয়ে এবার চাঙ্গা গ্রামীণ অর্থনীতি।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রবাসীরা বাড়তি রেমিটান্স পাঠিয়ে থাকেন। এবার ঈদেও তাই হয়েছে। এবার প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে বেশি রেমিটান্স পাঠিয়েছেন। প্রবাসী আয় বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। এতে হুন্ডির চাহিদা কমে গেছে। হুন্ডির মাধ্যমে যারা টাকা নিতেন, আগস্টের পর থেকে তাদের চাহিদা কম। কারণ অনেকের একাউন্ট ফৃজ হয়ে গেছে বা আরো বিভিন্ন কারণ যোগ হয়েছে। চাহিদা কমায় ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয়ের টাকা বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, কিছু প্রবাসী রেমিটান্স যোদ্ধা, এতদিন তারা ইনফরমাল ওয়েতে দেশে টাকা পাঠাতেন। কিন্তু ৫ আগস্টের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের চিন্তা-চেতনায় বড় পরিবর্তন এসেছে। তারা সবাই চাচ্ছেন ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটান্স পাঠাতে। এ কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা বেশি আসছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে দেশে রেমিটান্স এসেছে ২ হাজার ১৪৪ কোটি ডলার। গত বছরে একই সময় রেমিটান্স আসে এক হাজার ৬৫০ কোটি ডলারের কিছু বেশি।
আরিফ হোসেন খান বলেন, প্রবাসী আয় বাড়াতে বিদেশগামী কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নের পাশাপাশি ভাষাগত দক্ষতা বাড়ানো জরুরি। আমাদের দূতাবাসগুলোর সঙ্গে কথা বলছি, তারাও যেন সেখানকার বাঙালি কমিউনিটির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে, তাদের ব্যাংকিং সেক্টরে টাকা পাঠানোর যে সুফলÑ সে সম্পর্কে অবগত করে।

সিনিয়র ব্যাংকাররা বলেন, হুন্ডি পুরোপুরি বন্ধ হলে এবং বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার ঠেকানো গেলে প্রতি মাসেই ৩ বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব। বাংলাদেশের প্রায় এক কোটির বেশি মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রবাসী হিসেবে কাজ করেন। বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, রেমিটান্স অর্জনকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান নবম এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে তৃতীয়। দক্ষিণ এশিয়ায় রেমিটান্স আয়ে ইনডিয়া প্রথম এবং পাকিস্তান দ্বিতীয়।

এসডোর উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ ড. নিখিল রঞ্জন সাহা বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে যে কয়েকটি নিয়ামক সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বৈদেশিক রেমিটান্স। এর মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আয় ও সঞ্চয় বৃদ্ধিতে গ্রামীণ এলাকায় বিনিয়োগ বাড়ছে। কেউ পুকুর, কেউ কেউ গরু-ছাগলের খামার, আবার কেউ ফসলি জমি কিনছেন, কেউবা ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। যার ফলে সেখানে কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। যারা বিদেশে যান, তাদের বেশির ভাগেরই পরিবার গ্রামে থাকেন। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ থেকে তারা বিপুল পরিমাণ ব্যয় করেন। তাদের ব্যয় বৃদ্ধিতে গ্রামীণ জনপদে অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের দারিদ্র্য দূরীকরণে প্রধান ভূমিকা রাখছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটান্স।

ঈদকে ঘিরে প্রবাসীদের আয় ও শহরের মানুষ গ্রামমুখী হওয়ায় গ্রামীণ হাটবাজারে টাকার প্রবাহ বৃদ্ধি পায়। সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের বোনাস, জাকাত ও ফিতরার টাকায় গ্রামীণ অর্থনীতিতে টাকার প্রবাহ বেড়ে যায়। এতে গ্রামে নিত্যপ্রয়োজনীয়সহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে বাড়ে জোগান এবং দামও। মূলত এ বাড়তি চাহিদা এবং জোগান সক্ষমতাই গ্রামের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তেলে। ফলে সচল হয়ে ওঠে গ্রামীণ অর্থনীতি। এ সময় নিম্ন আয়ের মানুষের হাতেও টাকা লেনদেন হয়ে থাকে। এতে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। এছাড়া রেমিটান্সের ওপর নির্ভর করে গ্রামকেন্দ্রিক অর্থনীতি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সব মিলিয়ে অন্যান্য বারের মতো এবারো চাঙ্গা হয়ে উঠেছে গ্রামের অর্থনীতি।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বেসরকারি গবেষণা অনুসারে ঈদ ও রমজানে অর্থনীতিতে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার অতিরিক্ত লেনদেন হয়। এ টাকার বড় অংশই যায় গ্রামে। রমজান ও ঈদের মতো উৎসব এলেই বাড়তি টাকার প্রবাহে সচল হয়ে ওঠে গ্রামের অর্থনীতি। ঈদুল ফিতরে শহরের বড় একটি অংশ ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে গ্রামে যান। এরা বাড়তি খরচের কথা চিন্তা করে গ্রামে যাওয়ার আগে থেকেই সাধ্য অনুযায়ী সঞ্চয় করেন এবং বেতন-বোনাস বাচিয়ে সঙ্গে নিয়ে যান। এসব টাকা বিভিন্ন প্রয়োজনে গ্রামেই হাতবদল হয়। গ্রামীণ পর্যটন খাতেও যোগ হয় বাড়তি টাকার প্রবাহ। সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় হয় নতুন পোশাক ক্রয়ে।

তিনি আরো বলেন, এবারের ঈদে অর্থনীতির আকার, ধরন ও ব্যাপ্তি অনেক বেড়েছে। মানুষ এ উৎসব ঘিরে প্রচুর অর্থ খরচ করেন। এতে উৎপাদনকারী, আমদানিকারক, ব্যবসায়ী প্রত্যেকে কোনো না কোনোভাবে লাভবান হচ্ছেন। ফলে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে ।

বিআইডিএসের অর্থনীতি বিশ্লেষক ড. আবুল কালাম আজাদ বলেন, বাংলাদেশের জন্য বৈদেশিক রেমিটান্স দেশে দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করছে। দেশের জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নিম্ন আয়ের কাজকর্মের ওপর নির্ভর করে, বিশেষ করে কৃষি শ্রমিক, দিনমজুর তাদের দারিদ্র্য থেকে বের করে আনে এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করে। এই বৈদেশিক রেমিটান্স স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং আবাসনের মতো প্রয়োজনীয় চাহিদাগুলি মেটাতে সহায়ক, যার ফলে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত হচ্ছে।

 

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *