গাফফার খান চৌধুরী
সম্প্রতি ঢাকা ছাড়াও দেশের অনেক শহরে আশঙ্কাজনকহারে বেড়েছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। ছিনতাইকারীদের হাতে খুন জখমের মত ঘটনাও ঘটছে। এতে করে মানুষের মধ্যে রীতিমত আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানেও আশাতীতহারে ছিনতাইকারী গ্রেপ্তার না হলেও তাদের তৎপরতা কিছুটা কমেছে।
এক এলাকার ছিনতাইকারীরা আরেক এলাকায় গিয়ে ছিনতাই করে গা ঢাকা দিচ্ছে। অধিকাংশ ছিনতাইকারী বয়সে কিশোর ও তরুণ। এদের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগেরই জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। ঘন ঘন ছিনতাইয়ের কৌশল ও স্থাপন পরিবর্তন করায় এবং এনআইডি কার্ড না থাকার কারণে অধিকাংশ ছিনতাইকারী গ্রেপ্তার হচ্ছে না। কোন কোন সময় তাদের গ্রেপ্তার করতে অনেক বেগ পেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।
গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, সম্প্রতি আশঙ্কাজনকহারে বেড়েছিল দ্রুত গতির ছিনতাই। বিশেষ করে ছুঁ মেরে হাত ব্যাগ, মোবাইল ফোন, স্বর্ণের চেইন, কানের দুল ছিনিয়ে নেওয়া। এছাড়া সুযোগ পেতে অস্ত্রের মুখে ছিনতাই করার ঘটনাও ঘটেছে অনেক। এসব ঘটনার অধিকাংশ ঘটেছে নিরিবিলি জায়গায়। তবে ব্যস্ত সড়কেও কিছু কিছু দূর্ধর্ষ ছিনতাইয়ের ঘটনা মানুষের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে।
সূত্রগুলো বলছে, বর্তমানে ছিনতাইয়ের নির্দিষ্ট কোন স্পট নেই। তবে অতীতের রেকর্ডপত্র মোতাবেক রাজধানীতে প্রায় সাড়ে ৪শ’ চিহ্নিত ছিনতাইয়ের স্পট আছে। এসব স্পটে ছিনতাই অতীতে হয়েছে। এখনও মাঝে মধ্যে হয়। সম্প্রতি ছিনতাইকারী গ্রুপগুলো কৌশল পরিবর্তন করেছে। সাধারণত যেসব ছিনতাইয়ের হট স্পট হিসেবে চিহ্নিত, স্বাভাবিক কারণেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা সেখানে বেশী থাকে। ছিনতাইকারীরাও কৌশল পাল্টে নতুন নতুন স্পট তৈরি করছে। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মত দ্রুত গতির ছোট ছোট যানবাহন নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেখানে সুযোগ পাচ্ছে বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি কম, সেখানেই ছিনতাই করছে। এমন কৌশলের কাছে অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও পেরে ওঠছে না।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, ছিনতাইকারীরা ছিনতাই করতে ব্যবহার করছে দ্রুত গতির মোটর সাইকেল, ইজিবাইক, সিএনজি, প্রাইভেটকারসহ ছোটখাটো যানবাহন। ছিনতাইয়ে সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত হচ্ছে মোটরসাইকেল। যেসব যানবাহন ছিনতাই কাজে ব্যবহৃত হয়, তার প্রতিটিরই দুইটি করে নম্বর প্লেট থাকে। আসল নম্বর প্লেটের উপর নকল নম্বর প্লেট লাগিয়ে ছিনতাই করছে। ছিনতাই শেষে নকল নম্বর প্লেট খুলে ফেলে দিচ্ছে। অনেক সময় আসল নম্বর প্লেটের মত হুবহু নকল নম্বর প্লেট ছিনতাইকারীরা সঙ্গে রাখছে। ছিনতাই বা ডাকাতির পর নকল নম্বর প্লেটটি খুলে ফেলে দিয়ে আসলটি লাগিয়ে চলে যাচ্ছে। এতে করে গাড়ির নম্বর প্লেট দেখে তাদের আর আটক বা গ্রেপ্তার বা সন্দেহ করার সুযোগ থাকছে না। এমনকি সন্দেহভাজন হিসাবে ধরার পরেও তাদের ছিনতাইকারী হিসেবে শনাক্ত করা যাচ্ছে না। নম্বর প্লেট পরিবর্তন করার কারণে ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি, ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত হয়েছে বলে অকাট্য প্রমাণ মিলছে না।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, কৌশলের এখানেই শেষ না। রাতে পুলিশ বা র্যাব টহলে থাকে। ছিনতাইকারীরাও তাদের মত রাস্তায় টহলে থাকে। সন্দেহজনকভাবে তাদের আটকিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও তাদের ছিনতাইকারী হিসেবে শনাক্ত করা যায় না। কারণ তারা অনেক দূর থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে সঙ্গে থাকা অস্ত্রশস্ত্র নিরাপদ জায়গায় অন্ধকারে ফেলে দেয়। তখন তারা নিজেদের সাধারণ পথচারী বা যাত্রী বলে দাবি করে। সন্দেহজনকভাবে তাদের গ্রেপ্তার করা হলেও তারা জামিনে বেরিয়ে যাচ্ছে। কারণ ছিনতাইয়ের সময় হাতেনাতে ধরা না পড়া পর্যন্ত, তারা অনেকটাই নিরাপদ থাকছে।
আইনশৃঙ্খল্ াবাহিনী বলছে, সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদের সূত্রধরে অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার হলেও তা আদালতে গিয়ে টিকছে না। কারণ ছিনতাইকারীরা আদালতের কাছে দাবি করে, পুলিশ অন্য জায়গা থেকে অস্ত্র এনে তাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। এমন কৌশলে আইনের সুযোগ নেয় ছিনতাইকারীরা। আবার ছিনতাইকারীদেরও নিজস্ব লোকজন আছে। যারা গ্রেপ্তার হওয়া তাদের জামিনের ব্যবস্থা করে থাকেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশ বলছে, সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার ঘটে ঈদ বা রোজার সময়। ঢাকার বাইর থেকে ছিনতাইকারীদের ভাড়া করে আনে রাজধানীর পেশাদার ছিনতাইকারী গ্রুপগুলো। তারা বড় ধরণের ছিনতাই করে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে আবার গ্রামে গিয়ে আত্মগোপনে চলে যায়। এ ধরণের ছিনতাইকারীরা সাধারণত নিজ গ্রামে থাকে না। দূরের কোন আত্মীয়র বাড়িতে আশ্রয় নেয়। এসব ছিনতাইকারীদের আবার একাধিক স্ত্রী থাকে। তারা বছরে বড় বড় কয়েকটি ছিনতাই করেই আত্মগোপনে চলে যায়। এ ধরণের ছিনতাইকারীদের টার্গেট ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের টাকা উত্তোলনকারী বা জমাদানকারীরা।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এমন অনেক ছিনতাইকারী আছে, যারা বড় ধরণের একাধিক ছিনতাই করে ভাগের মোটা অঙ্কের টাকা পেয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে ব্যবসা করছে। যদিও মোটা অঙ্কের টাকা স্থানান্তরের জন্য প্রতিটি থানায় পুলিশের মানি এস্কর্ট টিম আছে। অনেকেই আস্থাহীনতার কারণে টাকা স্থানান্তরের জন্য পুলিশের শরণাপন্ন হন না। তখনই এ ধরণের ছিনতাইয়ের সম্ভবনা বেশী থাকে।
সূত্রটি বলছে, অধিকাংশ ছিনতাইকারীই বয়সে কিশোর বা তরুণ। এদের শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশীর জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। এমন সুযোগটিকে কাজে লাগায় তারা। গ্রেপ্তারের পর স্বাভাবিক কারণেই তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা দায়ের হয়। গ্রেপ্তাররা নিজেদের নাম ঠিকানা ইচ্ছা করেই ভুল দেয়। এনআইডি কার্ড না থাকার কারণে তাদের দেওয়া পরিচয় শতভাগ সঠিক কিনা তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। জামিনে বেরিয়েই তারা আত্মগোপনে চলে যায়। পুলিশ বা আদালতের তরফ থেকে আসামীদের দেওয়া ঠিকানা মোতাবেক বার বার নোটিশ পাঠানো হলেও কোন উত্তর পাওয়া যায় না। কারণ তাদের নাম ঠিকানা ভুল। শেষ পর্যন্ত পুলিশকে অনেকটা বাধ্য হয়েই তাদের নাম ঠিকানা পাওয়া যায়নি এবং আসামীরা পলাতক আছে মর্মে আদালতে প্রতিবেদন দিতে হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলছেন, ছিনতাই ঠেকাতে চেকপোষ্ট, টহল জোরদারসহ নানা কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। পুলিশের সঙ্গে র্যাব ও আনসার সদস্যরাও কাজ করছেন।
র্যাব জানিয়েছে, অপরাধীদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। প্রতিদিন গড়ে অন্তত শুধু ঢাকা থেকেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে ১০ জন করে ছিনতাইকারী।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার ফুসফুস হিসেবে পরিচিত হাতিরঝিলে হরহামেশাই ছিনতাই হত। হাত বাড়ালেও মিলত মাদক। পরবর্তীতে রাজধানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ হাতিরঝিল কেন্দ্রিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণে দায়িত্ব দেয় পুলিশের অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করে রীতিমত সুনাম অর্জনকারী আনসার কমান্ডার শাহ আলমকে।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে আনসার কমান্ডার শাহ আলম জানান, দৃষ্টিনন্দন হাতিরঝিলে প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী আসেন। অথচ এমন সুযোগটিকেই কাজে লাগানোর চেষ্টা করে ছিনতাইকারীসহ নানা ধরণের অপরাধীরা। এছাড়াও এলাকাটিতে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত ছিল। হাতিরঝিল ছাড়াও মগবাজার, কারওয়ান বাজার, তেজগাঁও, গুলশান ও বাড্ডা রামপুরার আংশিক এলাকার অপরাধ নির্মূলে আনসারের টহল বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আছে এসব এলাকার অপরাধ। টহল বাড়ানোর পাশাপাশি রাজউকের নির্বাহী ম্যজিষ্ট্রেট ও থানা পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে অপরাধ নির্মূলে অভিযান চলছে।
দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সর্ম্পকে বাংলাদেশ পুলিশের মুখপাত্র ও পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের সহকারি মহাপরিদর্শক ইনামুল হক সাগর বলছেন, আশঙ্কাজনকহারে ছিনতাই বেড়েছিল। এটি অস্বীকার কার কোন সুযোগ নেই। তবে সম্প্রতি পুলিশের সকল ইউনিটের টহল, গোয়েন্দা নজরদারি, অপরাধীদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রাখা, চেকপোষ্ট বসিয়ে তল্লাশী কার্যক্রম পরিচালনা, ছিনতাইয়ের স্পটগুলো চিহ্নিত করে টহল বাড়ানোর কারণে সম্প্রতি ছিনতাই ও ডাকাতির মত অপরাধ অনেকটাই কমে এসেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ধারাবাহিক অভিযানে অপরাধীদের গ্রেপ্তার অব্যাহত থাকবে।