মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান
খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার
মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসবের তারিখ নির্ধারিত হয় নতুন চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করে। মুসলমানরা যে হিজরি সন ব্যবহার করেন, তা চন্দ্র-বর্ষপঞ্জিনির্ভর। তবে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের মাধ্যমে কোন দেশে কখন নতুন চাঁদ দেখা যাবে তা বহু আগে থেকেই হিসাব করে বলে দেয়া সম্ভব। সে কারণে একদল প্রশ্ন তুলছেন, কেন তাহলে মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসবের তারিখ নির্ধারণ নিয়ে এত বিতর্ক এবং বিভ্রান্তি? কেন একটি নির্দিষ্ট তারিখে ধর্মীয় উৎসব করার ব্যাপারে মুসলিম ধর্মীয় নেতারা এক হতে পারছেন না? এ প্রসঙ্গটি আবারো আলোচনায় এসেছে সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠান ঘিরে।
তারেক রহমান :
একই দিনে রোজা শুরু ও ঈদ উদ্যাপন করা যায় কি না সে চিন্তা করার আহ্বান জানিয়েছেন।
‘সারা বিশ্বের মানুষের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ একই দিনে রোজা শুরু ও ঈদ উদযাপন করতে পারেন কি না’ এ বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি দেশের আলেম-ওলামাদের চিন্তা করার অনুরোধ জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ২ মার্চ ২০২৫ রোববার সন্ধ্যায় রাজধানীর লেডিস ক্লাবে ওলামা-মাশায়েখ ও এতিমদের সম্মানে বিএনপি আয়োজিত ইফতার মাহফিলে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ অনুরোধ জানান তারেক রহমান।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি একটি স্পর্শকাতর বিষয় সন্দেহ নেই। কারণ শবে বরাতের চাঁদ দেখা প্রশ্নে আদালতে যাওয়ার ঘটনাও এদেশে ঘটেছে। খালি চোখে চাঁদ দেখা যাওয়ার পরই হিজরি সনের একটি নতুন চান্দ্রমাস শুরু হবে ইসলামি এ বিধানকে সামনে রেখে বাংলাদেশের বহু ধর্মীয় নেতা এখনো খালি চোখে চাঁদ দেখা যাওয়ার ওপর নির্ভর করতে চান। তবে আরেকটি অংশ মনে করেন, ইসলামি উম্মাহ যেহেতু পৃথিবীজুড়ে, তাই সবার সঙ্গে মিলিয়ে তারিখ নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা পৃথিবীর মুসলমানরাই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভেবেছেন এবং তাদের বড় অংশই একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন।
ওআইসি ইন্টারন্যাশনাল ফিকাহ অ্যাকাডেমি :
যদি কোনো এক দেশে নতুন চাঁদের উদয় প্রমাণিত হয়, তবে বিশ্বের সকল মুসলমানকে অবশ্যই তা মেনে চলতে হবে। চাঁদের উদয়স্থলের ভিন্নতা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ রোজা শুরু ও শেষ করার বিধান বিশ্বজনীন।
ওআইসির সিদ্ধান্ত
২০১৬ সালের মে মাসে ইস্তাম্বুলে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়েছিল টার্কির উদ্যোগে। সেখানে সউদি আরব, টার্কি, কাতার, জর্ডান, মালয়শিয়া, ইউনাইটেড আরব এমিরেটস, মরক্কোসহ ৫০টি দেশের ধর্মীয় পণ্ডিত এবং বিজ্ঞানীরা অংশ নেন। ‘ইন্টারন্যাশনাল হিজরি ক্যালেন্ডার ইউনিয়ন কংগ্রেস’ নামে পরিচিত এ সম্মেলনে হিজরি ক্যালেন্ডার নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলমানদের মধ্যে যে বিভক্তি সেটা নিরসনে এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
সম্মেলনে দুটি প্রস্তাব বিবেচনা করা হয়েছিল। প্রথমত, সারা বিশ্বের জন্য দ্বৈত বর্ষপঞ্জি চালু করা, পূর্ব গোলার্ধের জন্য একটি, আর পশ্চিম গোলার্ধের জন্য আরেকটি। আর দ্বিতীয় প্রস্তাবটি ছিল, সবাইকে একটি বর্ষপঞ্জির মধ্যে নিয়ে আসা। শেষপর্যন্ত বেশিরভাগ প্রতিনিধি এবং বিশেষজ্ঞ একটি বর্ষপঞ্জির পক্ষেই মত দেন।
টার্কির প্রেসিডেন্সি অফ রিলিজিয়াস অ্যাফেয়ার্সের সে সময়ের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ গোরমেজ তখন একটি টার্কিশ সংবাদপত্র ডেইলি সাবাহকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘এ নতুন বর্ষপঞ্জি মেনে নিতে কিছু দেশ হয়তো অসুবিধায় পড়বে, কিন্তু এটি যাতে বিশ্বজুড়ে গৃহীত হয় সে ব্যাপারে ওআইসি তাদের প্রভাব কাজে লাগাতে পারে। আজকের যুগে, যখন মানুষ চাঁদে যেতে পারে এবং চাঁদ-সূর্যের প্রতি মূহূর্তের গতি পর্যবেক্ষণ করতে পারে, তখন পাহাড় বেয়ে উঠে খালি চোখে চাঁদ দেখতে হবে বলে গোঁ ধরে থাকাটা ভুল।’
এর আগে ১১ থেকে ১৬ অক্টোবর ১৯৮৬ সালে জর্ডানের রাজধানী আম্মানে ‘অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কোঅপারেশন’ বা ওআইসির সহযোগী সংগঠন ‘ওআইসি ইন্টারন্যাশনাল ফিকাহ অ্যাকাডেমি’র একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন হয়। ওআইসিভুক্ত দেশগুলো এই অ্যাকাডেমির মতামতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সেই শীর্ষ সম্মেলনের ১৮(৬-৩) নাম্বার সিদ্ধান্ত ছিল চান্দ্রমাসের শুরু শনাক্তকরণ প্রসঙ্গে। শতাধিক শরিয়া বিশেষজ্ঞ সর্বসম্মতভাবে যে সিদ্ধান্তে আসেন:
‘প্রথমত, যদি কোনো এক দেশে নতুন চাঁদের উদয় প্রমাণিত হয়, তবে বিশ্বের সব মুসলমানকে অবশ্যই তা মেনে চলতে হবে। চাঁদের উদয়স্থলের ভিন্নতা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ রোজা শুরু ও শেষ করার বিধান বিশ্বজনীন।
দ্বিতীয়ত, (চান্দ্রমাসের প্রথম দিন নির্ধারণের জন্য) নতুন চাঁদ দেখা মেনে নেয়া বাধ্যতামূলক। তবে মহানবী (সা.)-এর বাণী এবং বৈজ্ঞানিক বাস্তবতাকে বিবেচনায় রেখে যে কেউ জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব এবং বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রসমূহের সহায়তা নিতে পারেন।’
মুসলমানপ্রধান দেশগুলোর শীর্ষ সংগঠন ওআইসির ৫৭টি সদস্যরাষ্ট্রের অন্যতম বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে চাঁদ দেখা
জানা যায়, বাংলাদেশে ধর্মীয় দিবসের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ‘জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি’র সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। এতে যে বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া হয় তা হলো, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে চাঁদ দেখা গেলেই সে অনুযায়ী রোজা বা ঈদ হবে। এমনকি ‘সউদি আরবে ঈদ হলেই বাংলাদেশে হবে’Ñ সেটিও হবে না সময়ের পার্থক্যের কারণে। বাংলাদেশে চাঁদ দেখার প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। ঈদুল ফিতরের ক্ষেত্রে সাধারণত রোজার মাস শেষ হওয়ার দিকে, অর্থাৎ ২৯ রোজার দিন বিকেলে দায়িত্বপ্রাপ্ত ধর্মমন্ত্রীর সভাপতিত্বে ১৭ সদস্যের জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি বৈঠকে বসে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সদস্য সচিব হিসেবে কাজ করেন। সেদিন যদি দেশের কোথাও চাঁদ দেখা যায় তাহলে পরদিন ঈদের ঘোষণা দেয় ফাউন্ডেশন, আর তা না হলে ত্রিশ রোজা শেষেই ঈদ হয়ে থাকে। এ কারণে ২৯ রোজার দিন সকালে অধিকাংশ দৈনিক পত্রিকার কমন হেডলাইন থাকে ‘আজ চাঁদ দেখা গেলে কাল ঈদ’।
মূল চাঁদ দেখা কমিটির সঙ্গে একযোগে প্রতিটি জেলায় একটি করে কমিটি কাজ করে। দেশের কোথাও চাঁদ দেখা গেলে সেটি স্থানীয় প্রশাসন বা ইসলামিক ফাউন্ডেশন সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে জেলা কমিটির কাছে পৌঁছায়। পরে জেলা প্রশাসন দ্রুত সেটি নিশ্চিত করে বিভিন্নভাবে যেমন স্থানীয় অনেকে চাঁদ দেখেছে কি না কিংবা স্থিরচিত্র বা ভিডিওচিত্র এসব দ্রুত সংগ্রহ করে নিশ্চিত হয়ে থাকে স্থানীয় প্রশাসন। সেক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য ও ভালো দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন কাউকে চাঁদ দেখতে হবে। পরে সে খবরটি যাচাই করে জেলা কমিটি হয়ে কেন্দ্রীয় চাঁদ দেখা কমিটির হাতে পৌঁছায়। একই সঙ্গে আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেশজুড়ে যে ৭৪টি স্টেশন আছে সেখান থেকেও তথ্য নেয় চাঁদ দেখা কমিটি। যদি আবহাওয়া অনুকূল না থাকে অর্থাৎ খালি চোখে চাঁদ দেখার সুযোগ না থাকলে আবহাওয়া স্টেশন থেকে পাওয়া তথ্যও চাঁদ দেশের আকাশে উঠেছে কি না তা নিশ্চিত হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আরো জানা যায়, চাঁদ উঠলে সেটি কোথায় কত ডিগ্রিতে অর্থাৎ তার অবস্থান কী হবে এবং কতক্ষণ সময় ধরে দেখা যেতে পারে সেজন্য আবহাওয়া অফিসের একটি বিভাগ আগে থেকেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতেই হিসাব-নিকাশ করে স্টেশনগুলোকে জানিয়ে থাকে। তার ওপর ভিত্তি করে সব স্টেশন কাজ করে এবং সম্ভাব্য সময় ও স্থানে খালি চোখে ও যন্ত্রের সাহায্যে দেখা হয়। আবার যেহেতু একটি নতুন চাঁদ দৃশ্যমান হতে বেশ কিছুক্ষণ (অনেক ক্ষেত্রে ৩০ ঘণ্টাও হতে পারে) সময় লাগে, সে ক্ষেত্রে যন্ত্রের সাহায্য নেয়াটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। যদি কোথাও চাঁদ ওঠে তাহলে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য যদি সেটি খালি চোখে দেখা না যায়, তখন যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। অপটিক্যাল থিওডিলাইট নামে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন টেলিস্কোপ দিয়ে আবহাওয়া স্টেশনগুলো কাজ করে থাকে। ১০ জুন ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত ‘সমকাল’-এর প্রতিবেদনে জানানো হয়, ঈদের চাঁদ দেখার জন্য ঘোষিত একটি টেলিস্কোপের দাম ৫০ লাখ টাকা।
চাঁদ উঠলে সেটি কোথাও না কোথাও খালি চোখে না হলে টেলিস্কোপে ধরা পড়বেই। আর সেটি দেখামাত্রই আবহাওয়া বিভাগ সংশ্লিষ্টদের জানিয়ে দিয়ে থাকে। এভাবেই ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নেতৃত্বে সারা দেশের কমিটিগুলো ও আবহাওয়া বিভাগ একযোগে কাজ করে ঈদ ও অন্যান্য ধর্মীয় দিবসের চাঁদ দেখার তথ্য নিশ্চিত করে থাকে।
বাংলাদেশে মূলত রাষ্ট্রনির্ধারিত ভৌগোলিক অবস্থানকে মাথায় রেখেই চাঁদের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের আগে পশ্চিম পাকিস্তান বা বর্তমান পাকিস্তানে যেদিন ঈদ ঘোষিত হতো, সেদিন এখানেও ঈদ পালিত হতো। বাংলাদেশের একাধিক প্রবীণ নাগরিক জানান, এমনো হয়েছে রাতে সেহরি খেয়ে রোজা রেখে পরদিন সকালে উঠে শুনেছেন সেদিন ঈদ! কারণ পশ্চিম পাকিস্তানে চাঁদ দেখা গিয়েছে। রোজা ভেঙে দ্রুত তারা ঈদের নামাজ পড়তে গিয়েছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলেও একবার দেশের মানুষ তারাবির নামাজ পড়তে গিয়ে জানতে পারেন পরদিন ঈদ হবে!
স্বাধীনতার পর অনেকবারই বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানে আলাদা তারিখে ঈদ হয়েছে। একই ঘটনা ইনডিয়ার সঙ্গেও ঘটেছে। ১৯৪৭ সালের আগে বাংলাদেশের সঙ্গে ইনডিয়ার অনেক অংশের ঈদ একই দিনে হতো। কিন্তু পরবর্তীকালে দুই দেশের মধ্যে আলাদাভাবে ঈদ উদযাপিত হয়েছে। এমনও হয়েছে, সীমান্তের এক প্রান্তের মানুষ যেদিন ঈদ করছেন অপর প্রান্তের মানুষ ভিন্ন দিন ঈদ করেছেন। এ কারণে কেউ কেউ হাইপোথেটিকাল যে প্রশ্নটি তুলেছেন তা হলো, ‘যদি পৃথিবীর সব মানুষ মুসলমান হয়ে যান এবং পৃথিবীতে একটি মাত্র দেশ থাকে, তবে ঈদের তারিখ কীভাবে নির্ধারিত হবে?’
একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। আল জাজিরা ২৭ মে ২০১৭ তারিখের এক প্রতিবেদনে জানায়, সউদি আরবসহ ৩৩টি মুসলিম দেশ ২৭ মে রমজান মাস শুরুর ঘোষণা দেয়। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, টার্কি এবং আমেরিকা, ইওরোপ ও অস্ট্রেলিয়াভুক্ত মহাদেশসমূহের মুসলিম সম্প্রদায় অ্যাস্ট্রোনমিকাল ক্যালেন্ডার অনুসারে একই দিন অর্থাৎ ২৭ মে রমজান মাস শুরুর ঘোষণা দেয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইনডিয়া এবং ইরাকের শিয়া মুসলিম সম্প্রদায় পরদিন ২৮ মে থেকে রমজান পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। আল জাজিরার প্রতিবেদনে যে ৩৩টি দেশের নাম আসে সেগুলোর মধ্যে আছে আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স, মালয়শিয়া, ইরাক ইত্যাদি। অর্থাৎ ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের মানচিত্রের ডান-বাম সব দিকের দেশই সেখানে ছিল। অর্থাৎ ভৌগোলিক অবস্থানের যে যুক্তি তুলে ধরা হয়, তা এখানে কাজ করেনি। জানা যায়, ২৮ জুলাই ২০১৪ সালে জাপান থেকে শুরু করে আলাস্কা পর্যন্ত পৃথিবীর ১৮২টি দেশে একই দিনে ঈদুল ফিতর স্থানীয় সৌর সময় অনুসারে পালিত হয়।
অ্যাস্ট্রোনমিকাল হিসাব অনুসারে চাঁদ কবে দেখা যাবে সেটি আগে থেকেই জানা সম্ভব। বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিকাল সোসাইটির দাবি, প্রতিটি হিজরি মাস শুরু হওয়ার সময় এখন জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জানা। এমনকি তারা আগামী কয়েক বছর পর্যন্ত প্রতিটি ঈদের দিন-তারিখ, প্রতিটি হিজরি মাস শুরু হওয়ার সুনির্দিষ্ট দিন জানেন। তারা প্রতিটি সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের তারিখও এখন বলে দিতে পারবেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশের জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির একজন সদস্য বলেছিলেন, ‘যদি তাদের হিসেবে শতকরা একভাগও গড়মিল হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়, সেক্ষেত্রে কী করব আমরা? সেক্ষেত্রে আমাদের নিজেদের চাঁদ দেখার ওপরই নির্ভর করতে হবে। ঈদ, রোজা, হিজরি মাস ইত্যাদি যেহেতু ইসলাম ধর্মের বিধান অনুযায়ী চলে, সেহেতু ধর্মীয় নির্দেশনা মেনেই এটা করা হবে, এটাই নিয়ম।’
ইমরান খান :
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আগ্রহী হন। তিনি পুরনো ধ্যান-ধারণায় পরিচালিত পাকিস্তানের জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি বিলুপ্তি ঘোষণা করেন।
চাঁদ দেখা নিয়ে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এত জটিলতায় যেতে চাননি। তিনি ক্ষমতায় থাকাকালে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বেছে নেন এবং ২০১৯ সালে ‘পুরনো ধ্যান-ধারণার’ পাকিস্তানের জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি বিলুপ্তি ঘোষণা করেন। পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটে এটি বেশ সাহসী সিদ্ধান্ত ছিল। রয়টার্সের সূত্র উল্লেখ করে ১০ মে ২০১৯ তারিখে ফ্রান্স টোয়েন্টিফোর শিরোনাম করে, ‘পাকিস্তান টার্নস টু সায়েন্স, ইনফিউরিয়েটিং মুনসাইটিং মোল্লাস’ বা ‘পাকিস্তান বিজ্ঞানমুখী হয়েছে, চাঁদ দেখা মোল্লাদের রাগিয়ে তুলেছে’।
পরমাণু বিজ্ঞানী ও ইসলামিক স্কলার ড. এম শমশের আলী এ বিষয়ে তার মতপ্রকাশ করে বলেন, ‘‘ধর্মীয় উৎসবের তারিখ নির্ধারণের জন্য ইসলামে যে বিধান আছে, তার সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনো বিরোধ নেই। কাজেই আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রয়োগ করে খুব সহজেই বলে দেয়া সম্ভব কখন হিজরি সনের নতুন চান্দ্রমাস শুরু হচ্ছে। ফলে সারা বিশ্বের মুসলমান চাইলে একই দিনে পালন করতে পারেন তাদের ধর্মীয় উৎসব, এ নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি বা সংশয় থাকে না। তারিখ নির্ধারণ নিয়ে একসময় যে বিতর্ক হতো, তার একটা যুক্তি ছিল। কারণ তখন চাঁদ খালি চোখেই দেখতে হতো। কোনো পাহাড়ের একদিক থেকে চাঁদ দেখা যেত, অন্যদিক থেকে দেখা যেত না। মুসলমানদের যে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী, সেগুলো ছিল বিচ্ছিন্ন, যোগাযোগ বর্তমানের মতো এত দ্রুত এবং ঘনিষ্ঠ ছিল না। কিন্তু এখন এসব অজুহাত দেয়ার আর সুযোগ নেই। পৃথিবী তো একটাই। চাঁদও একটা। প্রতি মাসেই চাঁদ ওঠে। কোথাও চাঁদ দেখা যাওয়ার মানে হচ্ছে সেই চান্দ্রমাস শুরু হয়ে গেল। পুরো বিশ্ব এখন তাৎক্ষণিক এবং ব্যাপক যোগাযোগের আওতায়। কাজেই এখন কোনো একটি জায়গায় চাঁদ দেখা যাওয়ার পর একই দিনে উৎসব না করার বিরুদ্ধে কোনো ওজর-আপত্তি থাকতে পারে না। আগে ঘোড়া পাঠিয়ে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নেয়া হতোÑ চাঁদ উঠেছে কি না। ঘোড়া ছিল সে সময়ের ‘মাধ্যম’। এখন মাধ্যম হয়েছে ইন্টারনেট।’’
ড. এম. শমশের আলী:
সারা বিশ্বের মুসলমানরা চাইলে একই দিনে পালন করতে পারেন তাদের ধর্মীয় উৎসব, এ নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি বা সংশয় নেই।
ড. এম শমশের আলী আরো যোগ করেন, ‘বিশ্বের নামকরা সব ধর্মীয় পণ্ডিত পরামর্শ করে ঠিক করেছিলেন একটা দেশে চাঁদ দেখা গেলে, অন্য দেশেও সেটা মানা হবে। ওআইসির এই সিদ্ধান্ত বিশ্বের অনেক দেশই গ্রহণ করেছে, কিন্তু উপমহাদেশের দেশগুলো শুধু নেয়নি। এর মধ্যে পাকিস্তানও তাদের চাঁদ দেখা কমিটি বাতিল করে অন্য সবার মতো একই দিনে মেনে চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে এ অঞ্চলে বাংলাদেশ শুধু একা হয়ে গেল! ধর্মীয় ক্যালেন্ডারের শুরুটা ধর্মীয়, কিন্তু গণনার পদ্ধতি তো বৈজ্ঞানিক। চাঁদ ওঠা, সূর্য ওঠা, এগুলো তো বৈজ্ঞানিক। বাংলাদেশ এখন কক্ষপথে স্যাটেলাইট ছেড়েছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যাপারে বাংলাদেশের বেশ আগ্রহ। তাহলে কেন আমরা এটা মেনে নেব না?’
বাংলাদেশের কিছু এলাকার জনগোষ্ঠীর একটি অংশের সউদি আরবের সঙ্গে মিলিয়ে রোজা ও ঈদ পালন করার সংস্কৃতি বহুদিন ধরেই চলে আসছে। যদিও দেশের অধিকাংশ মানুষই রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের অনুসারী। তারা মনে করেন, সময় ও প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে রাষ্ট্র যে সিদ্ধান্ত নেবে সে অনুসারে তা পালন করাই উত্তম। এতে দেশজুড়ে ঐক্য ও সাম্য বজায় থাকে।
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান : সাংবাদিক ও গবেষক