চট্টগ্রাম প্রতিনিধি
ফের বিচারকশূন্য হয়ে পড়েছে চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালত। মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় বদলিজনিত কারণে ফের বিচারকশূন্য হয়ে পড়ে এ আদালত। ফলে বরাবরের মতোই থমকে পড়েছে বিচার কাজ। ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা।
আদালতের সংশ্লিষ্ট সরকারি কৌঁসুলি কাজী ছানোয়ার আহমেদ লাভলু সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দুর্নীতির মামলা এই আদালতে বিচারাধীন। অনেক মামলা শেষ পর্যায়ে। তবে বিজ্ঞ বিচারক বদলির পর বিচারকাজে ভাটা পড়েছে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার দুর্নীতির মামলার বিচারের বিচারালয় চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালত। যেখানে রাঘব বোয়ালদের দূর্নীতির মামলা বিচারাধীন। কিন্তু বিচারক না থাকায় বিচারপ্রার্থীরা প্রতিদিনই এসে ভিড় করছেন, ফিরে যাচ্ছেন পরবর্তী তারিখ নিয়ে। দ্রুত বিচারক নিয়োগ না হলে ফের আদালতের বিচারকাজ বিলম্বিত হবে। আর এতে বিচারপ্রার্থীরাও হতাশ হবে।
আদালতের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আদালতে প্রতিদিন ২০-২৫ জন সাধারণ বিচারপ্রার্থী এসে ফিরে যাচ্ছেন। প্রতিবারই মামলার তারিখে নতুন তারিখ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা। বিশেষ করে বিভাগের অন্যান্য জেলাগুলো থেকে আসা বিচারপ্রার্থীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন বেশি। এছাড়া আসামিপক্ষও হয়রানি হচ্ছেন।
আদালত সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, গত ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক কবির উদ্দীন প্রামাণিককে ঢাকা বিশেষ জজ আদালত-৯-এ বদলি করা হয়। গত ৩ ফেব্রুয়ারি তিনি চট্টগ্রামের কর্মস্থল ছাড়েন। বর্তমানে আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারকের দায়িত্বে আছেন চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. সাইফুল ইসলাম।
এর আগে ২০১৫ সালে এই আদালতের বিচারক হিসেবে যোগদান করেছিলেন মীর রুহুল আমিন। তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন শেষে ২০১৯ সালের ৬ জানুয়ারি তিনি বদলি হন। এরপর দীর্ঘ ২৮ মাস আদালতটিতে কোনো বিচারক নিয়োগ হয়নি।
পরে ২০২১ সালের ২০ এপ্রিল যোগদান করেন বিচারক মুন্সী আব্দুল মজিদ। তিনিও প্রায় তিন বছর দায়িত্ব পালন শেষে বদলি হন। এরপর দীর্ঘ ৬ মাস বিচারকশূন্যতায় ফের স্থবির হয়ে পড়েছিল মামলার কার্যক্রম। এরপর ২০২৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর যোগদান করেন বিচারক কবির উদ্দীন প্রামাণিক।
আদালত সূত্র জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে মোট ৬০৮টি মামলা। যার মধ্যে দুর্নীতি ও অর্থপাচার সংক্রান্ত মামলা রয়েছে ৩৪৬টি। বাকি ২৬২টি বিভিন্ন আইনে দায়ের হওয়া দায়রা ও সিভিল মামলা।
এর মধ্যে রেলওয়ের আলোচিত কালো বিড়ালখ্যাত পূর্বাঞ্চলের সাবেক মহাব্যবস্থাপক ইউসুফ আলী মৃধাসহ তার সহযোগিদের দুর্নীতির ১১টি মামলা বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছে। যারমধ্যে ২০১২ সালে দায়ের হওয়া টিকেট ইস্যুয়ার পদে নিয়োগে অনিয়ম এবং টুল কীপার পদে নিয়োগে অনিয়ম উল্লেখযোগ্য। এসব মামলার মধ্যে তিনটি শেষপর্যায়ে রয়েছে। সবগুলোরই সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। দ্রুত বিচারক নিয়োগ না হলে এসব মামলা নি®পত্তি বিলম্বিত হবে।
এছাড়া ৪৩ লাখ ৪৩ হাজার ৯৯৪ টাকার তথ্য গোপন এবং ৬৬ লাখ ৭০ হাজার টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত স¤পদ অর্জনের অভিযোগে ২০০৭ সালে টেকনাফের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলা বিচারাধীন এই আদালতে। ২০২০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে এই মামলার বিচার শুরু হয়। বিচারের আদেশের বিরুদ্ধে বদি পরে হাইকোর্টে যান।
২০২২ সালের জানুয়ারিতে হাইকোর্ট সেই আবেদন খারিজ করে দেন। পরে একই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। সবশেষ গত ২৮ অক্টোবর এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন ইসলামী ব্যাংকের টেকনাফ শাখার সাবেক দুই কর্মকর্তা। এরপর পরপর দুই তারিখে সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য্য থাকলেও পুলিশ প্রটেকশনের অভাবে কাশিমপুর কারাগার থেকে চট্টগ্রাম কারাগারে হাজির না করায় তা পিছিয়েছে। এই মামলায় মোট ৪১ জন সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ স¤পন্ন হয়েছে। এরমধ্যে বিচারকশূন্যতায় মামলার গতিতে আরও ভাটা পড়বে।
এছাড়া এই আদালতে বিচারাধীন রয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) বিভিন্ন প্রকল্পে করা দুর্নীতি-অনিয়ম, বন্দর-কাস্টমসের দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগে দায়ের করা বেশ কয়েকটি মামলা। যেগুলো বিচারকশূন্যতার কারণে থমকে আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সদ্য সাবেক সাধারণ স¤পাদক অ্যাডভোকেট মো. আশরাফ হোসেন চৌধুরী রাজ্জাক বলেন, বিচারকদের বদলির পর দ্রুত বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান ¯পষ্ট। বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতসহ বেশ কয়েকটি আদালতে বর্তমানে বিচারকশূন্যতা রয়েছে। আমরা এ বিষয়ে বারবার সচিব মহোদয়কে বলেছি। আর বিশেষ জজ আদালত অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।
এ বিষয়ে চট্টগ্রামের আইনবিদ ও মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট জিয়া হাবিব আহসান বলেন, চট্টগ্রাম এমনিতেই অবহেলিত। এরমধ্যে বিচারক সংকটের অবস্থা ভয়াবহ। বিভাগীয় ¯েপশাল জজ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছি সেখানে বিচারকই নেই ওই আদালতের। তাহলে এই দুর্নীতিবাজদের বিচার কে করবে? মামলাগুলো বছরের পর ঝুলে থাকবে। এতে দুর্নীতিবাজদের পোয়াবারো হবে। বিচারপ্রার্থীরা হয়রানির শিকার হবে।