Jaijaidin

প্রশাসনে ফ্যাসিস্টের কালো ছায়া

Shah Alam Soulav
7 Min Read

বিশেষ প্রতিনিধি

স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতন এবং প্রধানমন্ত্রী, প্রভাবশালী মন্ত্রী, নেতা, গভর্নরসহ অনেকে পালিয়ে গেলেও প্রশাসনে আওয়ামী কালো ছায়া যেন কাটছেই না। অনেকে অভিযোগ করছেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা ফ্যাসিবাদের দোসররা এখন স্বরূপ প্রকাশ করতে শুরু করেছেন। তারা প্রতিনিয়ত তাদের অনুগত সদস্যদের সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। অভিযোগ আছে, প্রশাসনের পুরো নিয়ন্ত্রণ এখনো এ গ্রুপের হাতে রয়েছে। ফলে তারা সরকারের অগ্রগতিকে মানসিকভাবে সমর্থন না দিয়ে কাজের গতি কোথাও কমিয়ে কিংবা কোথাও বন্ধ করে দিয়েছেন। এতে প্রশাসনে সৃষ্টি হয়েছে গতিহীনতা। এদিকে প্রশাসনে গতি ফিরিয়ে আনতে অন্তর্বর্তী সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও তা কাজে আসছে না।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, প্রশাসনের প্রায় অর্ধেক মন্ত্রণালয়ে এখনো ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলের সচিবরা নিয়োজিত আছেন। গুরুত্বপূর্ণ অনেক মন্ত্রণালয়ে সচিবদের কোনো পরিবর্তন না হওয়ায় আওয়ামীপন্থি দলবাজ কর্মকর্তারাই পদোন্নতি পাচ্ছেন। তারা তাদের অবস্থান দৃঢ় রাখতে নিজস্ব বলয় সৃষ্টির যে ধারা ধরে রেখেছেন তাতে দল নিরপেক্ষ দক্ষ ও যোগ্য কর্মকর্তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। এতে এসব কর্মকর্তারা অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ও তাদের মূল্যায়ন না হওয়ায় অসহায় ও হতাশ হয়ে পড়েছেন।

প্রশাসনে আওয়ামী পুনর্বাসনের এ চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরাম। প্রশাসনে ফ্যাসিবাদের দোসরদের প্রতিরোধে তারা আগামী ১৯ এপৃল প্রেস কনফারেন্স করার ঘোষণা দিয়েছে। বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরাম তাদের পাচটি দাবি জানিয়েছে। দাবিগুলো হলো :

ক. সিভিল প্রশাসনে কর্মরত সব ক্যাডার, নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে যারা ফ্যাসিস্টদের দোসর ও দুর্নীতি পরায়ণ তাদের অবিলম্বে চাকরি থেকে অপসারণ এবং আইনের আওতায় আনতে হবে।

খ. নিরপেক্ষ প্রশাসনিক কাঠামো নিশ্চিত করার স্বার্থে সব চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করতে হবে।

গ. ফ্যাসিস্ট আমলে বৈষম্যের শিকার বর্তমানে কর্মরত সব ক্যাডার, নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ অন্য সংস্থা/দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করতে হবে।

ঘ. বৈষম্যের শিকার এখনো বঞ্চিত সব ক্যাডার, নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতিসহ প্রাপ্য সুবিধা প্রদান করতে হবে।

ঙ. ফ্যাসিস্টের দোসর ও দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি/পদায়নে যারা পৃষ্ঠপোষকতা করছেন এবং করবেন, তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামসহ প্রশাসনে ক্ষোভ আরো তীব্র আকার ধারণ করে সম্প্রতি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে মো. মফিদুর রহমানকে নিয়োগ দেয়ার ঘটনায়। তাকে অবিলম্বে এ পদ থেকে অপসারণের দাবি জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামসহ বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

জানা গেছে, আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগী আমলা মো. মফিদুর রহমানের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদের প্রসারে বই লেখা ও টিভি প্রোগ্রাম সঞ্চালনাসহ বিভিন্ন প্রচারণায় সরাসরি অংশগ্রহণের অভিযোগ আছে। তার লেখা ‘লক্ষ মানব সম্পদ উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর দর্শন’ নামে লেখা স্থান পায় ‘মুজিব মননে ও হৃদয়ে’ বইটিতে। তিনি পুরো আওয়ামী আমলে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। বিগত সরকারের আস্থাভাজন এ কর্মকর্তা ধারাবাহিক প্রমোশন পেয়ে প্রতিবার টুঙ্গিপাড়ায় মাজার জিয়ারত করতে গিয়েছেন সদলবলে।
প্রশাসনে প্রচলিত আছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও পরে পালিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের বিশ^স্ত দুই হাতের একজন হলেন এই মো. মফিদুর রহমান। অন্যজন অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সিরাজুন নূর চৌধুরী। তাকেও সচিব করার প্রক্রিয়া এগিয়ে চলছে বলে জানা গেছে। অর্থ বিভাগে দীর্ঘ সময় চাকরির কারণে তিনি পুরো মন্ত্রণালয়ে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। তার বিরুদ্ধে গণজাগরণ মঞ্চে সহযোগিতা করা এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে জিতিয়ে আনার মেকানিজমের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ আছে।

মো. মফিদুর রহমান ও সিরাজুন নূর চৌধুরীÑ এ দুজনই আবদুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ফ্যাসিস্ট শাসনের পক্ষে কাজ করেন এবং পদ ও পদোন্নতিসহ নানা ধরনের সুবিধা আদায় করেন। এরা দুজনেই প্রশাসনের ১৫ ব্যাচের কর্মকর্তা। অতিরিক্ত সচিব সিরাজুন নূর চৌধুরীও ধারাবাহিক পদোন্নতি পেয়েছেন। বর্তমানে অর্থ বিভাগের ‘সুপার উইং’ নামে পরিচিত প্রভাবশালী উইংয়ের দায়িত্বে আছেন তিনি। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার তাকে নানাভাবে পুরস্কৃত করেছে। সিরাজুন নূর চৌধুরীকে বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশনে সরকার মনোনীত সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ ক্যাপিটাল মার্কেটের (বিআইসিএম) পরিচালক পদেও নিয়োগ পান তিনি। যুগ্ম সচিব থাকা অবস্থায় সিরাজুন নূর চৌধুরীকে ‘উদ্ভাবন পুরস্কার ২০২১’ প্রদান করা হয়।
আবদুর রউফ তালুকদারের আশীর্বাদ পাওয়া আরেক কর্মকর্তা অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংক উইংয়ের প্রধানের দায়িত্ব পালনকারী ড. এ কে এম শাহাবুদ্দিন। তাকেও সচিব করার প্রক্রিয়া চলছে। ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে নিয়মিত পদোন্নতি পাওয়া এ কর্মকর্তা ছাত্রজীবনে ছাত্র লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে প্রচার করতেন।

সাবেক গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার তার অনুগত কর্মকর্তাদের মাধ্যমে এখনো অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রভাব বিস্তার করছেন বলে জানা যায়। অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় অভিযুক্ত এই পলাতক গভর্নর। তার সময়ে ফ্যাসিস্টের দোসর ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি কিছু ব্যাংক মালিকও বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তিনি তাদের নিয়ন্ত্রণ না করে উল্টো অনিয়ম-জালিয়াতিগুলোকে ঢেকে রাখার কাজে মনোযোগী ছিলেন।

অভিযোগ আছে, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ প্রায় প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে ফ্যাসিস্ট সহযোগীরা ভালো অবস্থানে আছে এখনো। এর কারণ হিসেবে অনেকে মনে করছেন, বর্তমান সরকারে যারা দায়িত্বশীল আছেন তাদের অনেকে দীর্ঘ সময় প্রশাসন থেকে দূরে থাকায় বর্ণচোরা আমলাদের চিনতে পারছেন না। কেননা তারা নিজেদের রূপ বদল করতে কোনো সময় নিচ্ছেন না। এ পক্ষটি নিজেদের অনুগতদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসাচ্ছেন, ফলে দীর্ঘ সময় পদোন্নতি বঞ্চিতরা বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছেন। আবার বঞ্চিত কিছু কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিলেও পদায়ন করা হচ্ছে না। কিন্তু প্রতিনিয়ত জনপ্রশাসন থেকে ফ্যাসিস্ট হাসিনার কর্মকর্তাদের নানা পদে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। তারাই প্রশাসনে কলকাঠি নাড়ছেন। পরিকল্পিতভাবে বঞ্চিতদের সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত করে তোলা হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে ব্যাচের প্রতিও বৈষম্য করা হচ্ছে।

অভিযোগ আছে, ১৭ এবং ১৮ ব্যাচের কর্মকর্তাদের কমিশনার বা ডিসি পদ থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠালেও ১৫ ব্যাচের ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। ১৫ ব্যাচের যারা কমিশনার বা ডিসি ছিলেন তারা স্বপদে বহাল থেকেছেন। ১৫ ব্যাচের আওয়ামী সমর্থক প্রভাবশালী কর্মকর্তারা এখনো সক্রিয়। এতেও প্রশাসনে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
অভিযোগকারীরা জানান, পদোন্নতি বঞ্চিত দক্ষ ও সৎ কর্মকর্তাদের প্রতি না তাকিয়ে এভাবে আওয়ামী পুনর্বাসন কার্যক্রম চালালে তা সরকারের জন্যই বিপদ ডেকে আনবে। ফ্যাসিস্ট প্রভাব মুক্ত করা না গেলে পুরো প্রশাসনই কালো ছায়ায় ঢেকে যাবে।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *