এম সাইফুল
পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের ‘ফোকাস গ্রুপ’ নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। ক্লিন ইমেজের বলা হলেও বিনিয়োগকারীরা এই গ্রুপের অধিকাংশ সদস্যকে বিতর্কিত বলছেন। এছাড়া বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠান বা স্টক এক্সচেঞ্জের সহযোগিতা নেয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, যাদের ফোকাস গ্রুপের সদস্য করা হয়েছে সবাই বাজার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। তাদের সঙ্গে টাস্কফোর্স নিয়মিত বৈঠক করছে। তাদের আলাদা কমিটি করার প্রয়োজন ছিল না। তারা এমনিতেই সহযোগিতা করছে। তাছাড়া যাদের নেয়া হয়েছে তাদের চেয়েও অনেক জ্যেষ্ঠ লোক পুঁজিবাজারে রয়েছেন।
পুঁজিবাজার সংস্কার ফোকাস গ্রুপের সদস্যরা হলেন- ভিআইপিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম, প্রাইম ব্যাংক সিকিউরিটিজ লিমিটেডের এমডি এবং সিইও মো. মনিরুজ্জামান, ইডিজিই এএমসির প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও আলী ইমাম, মিডওয়ে সিকিউরিটিজ লিমিটেডের এমডি মো. আশিকুর রহমান, এ কে খান সিকিউরিটিজ লিমিটেডের সিইও মুহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিয়া, ক্যাল বাংলাদেশের এমডি ও কান্ট্রি হেড অ্যান্ড্রু দেশন পুষ্পরাজাহ, সেন্ট্রাল কাউন্টার পার্টি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিসিবিএল) জিএম ও সিটিও (ভারপ্রাপ্ত) এম ইমাম হোসেন, আহমেদ শেখ রায় অ্যান্ড কোং-এর পার্টনার শেখ তারেক জহির, আহমেদ হক সিদ্দিকী অ্যান্ড কোং-এর ম্যানেজিং পার্টনার মো. ওয়াদুদ আহমেদ এবং আইসিএবির সদস্য দীপক কুমার রায়।
জানা গেছে, কমিটির অন্যতম সদস্য ভিআইপিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম। ভিআইপিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের বিভিন্ন শেয়ারে দর বৃদ্ধির অভিযোগ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান জিয়া উদ্দিন আহমেদ পুঁজিবাজারের একটি তদন্ত কমিটির প্রধান। তিনি ওই কমিটিতে থাকায় স্বাধীন তদন্ত ও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রথম সংবাদ সম্মেলনেই প্রশ্ন করা হয়েছিল। তখন তিনি বলেছিলেন, মালিক হিসেবে আমি প্রতিষ্ঠান থেকে মুনাফা নিই। দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করি না। অনিয়ম হয় ব্যবস্থাপনাগত দিক দিয়ে। সেই অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের সিইও হলেন ফোকাস গ্রুপের সদস্য।
অন্যদিকে প্রাইম ব্যাংক সিকিউরিটিজ লিমিটেডের এমডি এবং সিইও মো. মনিরুজ্জামান আগে আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টের দায়িত্বে ছিলেন। তার সময়ে বেশ কয়েকটি আইপিও পুঁজিবাজারে আনা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ইডিজিই এএমসির প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও আলী ইমামকে নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। এ ছাড়া আলোচিত তিনজনই সিএফএ বাংলাদেশ সোসাইটির সঙ্গে জড়িত।
পুঁজিবাজারে আলোচিত ব্যক্তি প্রয়াত রকিবুর রহমানের ছেলে মো. আশিকুর রহমানকে নিয়েও আপত্তি রয়েছে। সেন্ট্রাল কাউন্টার পার্টি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিসিবিএল) জিএম ও সিটিও (ভারপ্রাপ্ত) এম ইমাম হোসেনকে নেয়া হয়েছে।
প্রশ্ন উঠেছে, যে সিসিবিএলকে তারা এতদিনেও আলোর মুখ দেখাতে পারেননি, সেই প্রতিষ্ঠানের লোক কিভাবে বাজার সংস্কার করবেন? এছাড়া অন্য সদস্য যারা রয়েছেন তাদের কিসের ভিত্তিতে ক্লিন ইমেজের তকমা দেয়া হলো?
এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ফজলুল বারী বলেন, বিএসইসির বর্তমান কমিশন ব্যর্থ। তাদের ব্যর্থতা ঢাকতে বিভিন্ন কমিটি করছে। বিতর্কিতদের নিয়ে ফোকাস গ্রুপ করেছে। তাদের ক্লিন ইমেজের সার্টিফিকেট দিয়েছে। ক্লিন ইমেজের সার্টিফিকেট দেয়া বিএসইসির কাজ নয়। এই কমিটিও ব্যর্থ হবে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চায়না যেহেতু ডিএসইর স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার, তাদের কাছ থেকে সহযোগিতা নিতে পারে। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকেও পরামর্শ নিতে পারে। ইতিপূর্বেও এসব উন্নয়ন সংস্থা পুঁজিবাজার উন্নয়নে বিভিন্ন তহবিল এবং পরামর্শ দিয়েছে। এ ছাড়া অন্য আন্তর্জাতিক অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট পরামর্শ দেয়।
জানা গেছে, পুঁজিবাজারের সার্বিক উন্নয়ন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক মানের পুঁজিবাজারের সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গঠিত ‘পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্স’ কর্তৃক ‘পুঁজিবাজার সংস্কার ফোকাস গ্রুপ’ গঠন করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
বিএসইসির সিদ্ধান্তে উল্লেখ করা হয়, আলোচনা ও সার্বিক বিবেচনাপূর্বক কমিশন কর্তৃক গঠিত ‘পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্স’-এর পরামর্শে উল্লিখিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত ‘পুঁজিবাজার সংস্কার ফোকাস গ্রুপ’-এর আদেশ জারির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পাশাপাশি ‘পুঁজিবাজার সংস্কার ফোকাস গ্রুপ’-এর সদস্যদের সম্মানী হিসেবে সভায় উপস্থিতির ভিত্তিতে প্রত্যেক সদস্যকে সভাপ্রতি ৮ হাজার টাকা প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এর আগে গত বছর ৭ অক্টোবর বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ স্বাক্ষরিত আদেশে ‘পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্স’ গঠন করা হয়। গঠিত টাস্কফোর্সের সদস্যরা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দীন, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ পিএলসির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এ এম মাজেদুর রহমান, হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোং-এর সিনিয়র পার্টনার এ এফ এম নেসার উদ্দীন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোস্তফা আকবর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন।
ওই আদেশে উল্লেখ করা হয়, গঠিত টাস্কফোর্সের অধীন বিভিন্ন ইসুভিত্তিক ফোকাস গ্রুপ থাকবে। প্রতিটি ফোকাস গ্রুপ নির্দিষ্ট বিষয়ে কাজ করবে এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে টাস্কফোর্সকে সুপারিশ করবে। উল্লেখ্য, কমিশনকে অবহিত করে ‘পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্স’ উপযুক্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ‘পুঁজিবাজার সংস্কার ফোকাস গ্রুপ’ গঠন করবে।
এ বিষয়ে পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন বলেন, আমরা পুঁজিবাজার সংস্কারে একটি ভিত রচনা করে যেতে চাই। অনেক পরিবর্তন আসবে। বিশেষ করে মার্জিন ঋণ এবং আইপিও নিয়ে বড় সংস্কার প্রস্তাব দেব। বাস্তবায়ন করবে কি না সেটি কমিশনের বিষয়। ফোকাস গ্রুপের যারা সদস্য রয়েছেন তারা অনেকেই বিভিন্ন জায়গায় কনসালটান্সি করেন। তারা বাজারে ক্লিন ইমেজের ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। তাদের প্রতি মিটিংয়ে ৮ হাজার টাকা দেয়া হবে। অথচ অনেকেই আছেন একদিন পরামর্শ দিয়ে ৭৫ হাজার থেকে এক লাখ টাকাও পান। এখানে এত বেশি দেয়া যাবে না।
এ বিষয়ে বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. রেজাউল করিম বলেন, টাস্কফোর্সকে কয়েকটি ফোকাস গ্রুপ করার এখতিয়ার দেয়া হয়েছে। একটি হয়েছে। ভবিষ্যতে যদি প্রয়োজন হয় এ ধরনের আরো ফোকাস গ্রুপ করতে পারবে। বিদেশি প্রতিষ্ঠান বা অন্যদের নিয়ে যদি প্রস্তাব আসে, সেটিও করা হবে।