শহীদুল ইসলাম সোহাগ
আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরের শাসনামলে ধারাবাহিকভাবে পাঠ্যবইয়ে বিভিন্ন বিষয় যুক্ত হয়েছে দলটির ইচ্ছানুযায়ী। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার পাঠ্যবইয়েও করেছে সংস্কার। সেই সংস্কার বা পরিমার্জনযুক্ত পাঠ্যবই হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের। কোন বিষয় পরিমার্জন করা হয়েছেÑ সেদিকেই এখন দৃষ্টি সবার।
২০২৫ শিক্ষাবর্ষে পাঠ্যবইয়ের সব অংশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পরিমার্জন করা হয়েছে। নবম ও দশম শ্রেণির বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা পাঠ্যবইয়ের ২৫ মার্চের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ অংশে স্বাধীনতার ঘোষণার জায়গায় পরিমার্জন এসেছে। অন্যান্য বইয়ের মতোই এখানে লেখা হয়েছে, ‘২৬ মার্চ তারিখে মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর তিনি ২৭ মার্চ তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে আবারো স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।’ এই অংশে গণহত্যার ছবি ও মেজর জিয়াউর রহমানের ছবি সংযুক্ত করা হয়েছে। পাঠ্যবইয়ের পেছনে যুক্ত হয়েছে জুলাই অভ্যুত্থানের দেয়াললিখন। এছাড়া ‘মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান’, ‘৫২ থেকে ২৪Ñ ইতিহাস এভাবেই ফিরে আসে’সহ বিভিন্ন নীতিকথা যুক্ত করা হয়েছে বিভিন্ন বইয়ে। বইয়ের শেষে শেখ হাসিনার ছবি বাদ দেয়া হয়েছে।
পঞ্চম শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইয়ের ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধ’ অধ্যায়ে পরিমার্জন করা হয়েছে। প্রথমেই ব্যবহার করা হয়েছে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ছবি। তারপর বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার ছবি। এই অধ্যায়ের ‘পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা’ অংশে লেখা হয়েছে, ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন মেজর জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন কি না তা লেখা নেই নতুন বইয়ে।
চতুর্থ শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইয়ের ‘১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ’ অধ্যায়ে পরিমার্জন করে লেখা হয়েছে, ২৬ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি ২৭ মার্চ আবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এই অধ্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের ছবির পাশাপাশি মেজর জিয়াউর রহমানের ছবিও ব্যবহার করা হয়েছে।
যুক্ত হয়েছে জুলাই অভ্যুত্থান পঞ্চম শ্রেণির ‘আমার বাংলা বই’য়ে ছয়টি প্রবন্ধ, কবিতা বা ছড়া নতুন করে যুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ‘আমরা তোমাদের ভুলব না’ শীর্ষক প্রবন্ধে শহিদ তিতুমীর, ইলা মিত্র, আসাদুজ্জামান, মফিজুর রহমান মল্লিক, শহিদ সার্জেন্ট জহুরুল হক, ড. মুহম্মদ শামসুজ্জোহাসহ ৯ জন শহিদের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহিদ আবু সাঈদ ও মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের ছবি ও অবদান।
জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত আগে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা পাঠ্যবইয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ও পতাকা নির্মাণের নিয়মাবলি এবং জাতীয় সঙ্গীত প্রচ্ছদের পরের পৃষ্ঠায় ছিল। এবার বইয়ের শেষ প্রচ্ছদের আগের পৃষ্ঠায় নেয়া হয়েছে।
থাকছে ক্যালিগ্রাফি ইসলামধর্মীয় পাঠ্যবইয়ে যুক্ত হয়েছে ক্যালিগ্রাফি। এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, পাঠ্যবইয়ে ক্যালিগ্রাফি ধরনের আল কোরআন ও আল হাদিস থাকছে। এছাড়া বৌদ্ধধর্মীয় পাঠ্যবইয়ে গৌতম বুদ্ধের বাণী, একইভাবে খৃস্টান ধর্মের বইয়ে খৃস্টের বাণী ও হিন্দু ধর্মের বইয়ে ধর্মীয় বাণী থাকছে।
বাদ গেছে কিছু গল্প-কবিতা পাঠ্যবই থেকে বেশ কয়েকটি গল্প-কবিতা বাদ গিয়ে নতুন লেখা যুক্ত হয়েছে। ‘ফাদার অফ দি নেশন’ বাদ দিয়ে যুক্ত হয়েছে ‘সেন্স অফ সেলফ’, ‘লোনলিনেস’। থাকছে ‘গ্রাফিতি’ নামের নতুন তিনটি অধ্যায়। এছাড়া পঞ্চম থেকে নবম-দশম শ্রেণির বাংলা ও ইংরেজি বইয়ে কিছু পাঠ্য বাদ দিয়ে নতুন লেখা যোগ করা হয়েছে।
সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে নতুন মুখ বাদ গেছে জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক সাকিব আল হাসান ও বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সাবেক সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের নাম-ছবি। তাদের স্থানে ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক নিগার সুলতানা জ্যোতি এবং দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক নারী গ্রান্ডমাস্টার রানী হামিদ। এছাড়া ইনডিয়ান ক্রিকেটের শচীন তেন্ডুলকারের ছবি সরিয়ে সেখানে ফুটবলার জামাল ভূঁইয়ার ছবি দেয়া হয়েছে। তবে পেলে, ম্যারাডোনা, ব্রায়ান লারার মতো অন্যদের ছবি আগের মতোই রয়েছে।
এছাড়া সপ্তম শ্রেণির তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বইয়ের ‘সমাজ জীবনে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি’ পাঠে সাকিব আল হাসানের টুইটার প্রোফাইলের ছবি সরিয়ে সেখানে জাতীয় দলের অন্যতম জ্যেষ্ঠ ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিমের প্রোফাইলের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। অন্যদিকে ষষ্ঠ শ্রেণির তথ্য-প্রযুক্তি বইয়ে আগে বাংলাদেশে ক্রিকেট বিশ্বকাপ উদ্বোধনের সময় সাকিবের একটি ছবি ব্যবহার করা হয়েছিল। নতুন বইয়ে সেটি বাদ দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অলিম্পিকের মশাল বহনের ছবি দেয়া হয়েছে।