Jaijaidin

দাবি-দাওয়ার আন্দেলনে ভোগান্তিতে নগরবাসী

Shah Alam Soulav
7 Min Read

আলতাব হোসেন

রাজধানীর রাজপথ যেন দাবি-দাওয়া আদায়ে মঞ্চ ওয়ে ওঠেছে। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো দাবি নিয়ে নামছেন রাজপথে. দাবি আদায়ের এই মৌসুমে নগরবাসীকে খসারত দিতে হচ্ছে। বিক্ষোভ-অবরোধে বিপর্যন্ত নগরজীবন। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো একের পর এক অবরোধের কবলে পড়ায় অফিসগামী মানুষ, রোগী পরিবহনসহ সবাই ভোগান্তিতে পড়ছেন। কেউ দীর্ঘ যানজটে আটকে থেকে মেজাজ হারাচ্ছেন, অনেকে ক্ষোভ ঝাঁড়ছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
আনসার থেকে পুলিশ, বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার থেকে বিডিআর কিংবা সাত কলেজ পৃথকীকরন থেকে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। যে যেভাবে পারছে দাবির পসরা নিয়ে বসছে রোজ। দাবির মিছিলকে অনেকেই বলছেন এ যেন ‘মামা বাড়ির আবদার’ । দাবি আদারে মিছিলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ঢাকার রাজপথ। যার তীর্থভূমিতে পরিণত হয়েছে শাহবাগ। এখন যে যেখানে পারছে, সেখানেই বসে পড়ছে, যৌক্তিক-অযৌক্তিক দাবি-দাওয়ার পসরা নিয়ে। গত ১৬ বছর মুখ বুজে থাকা বঞ্চিতদের সব মিছিল যেনো আছড়ে পরছে ৬ মাসের ইউনূস সরকারের ওপর। বলা হচ্ছে, এই ৬ মাসে ১৩৬টি আন্দোলন মোকাবিলা করতে হয়েছে অর্ন্তবর্তী সরকারকে। প্রতিদিনই এই তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে।

রোবববার অন্তত পাঁচ-ছয়টি পৃথক দাবিতে আন্দোলনকারীরা রাস্তায় নামে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর চতুর্দিকে নানা শ্রেণি- পেশার মানুষের দাবি-দাওয়া যেন বিস্ফোরণ ঘটেছে। এসব দাবি আদায়ে বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও অবস্থানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছেন তারা। সরকারি আমলা, ডাক্তার, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশাজীবী সংস্থাসহ বাদ যাচ্ছেন না শ্রমিকরাও। এ তালিকায় প্রতিদিনই যোগ হচ্ছে নতুন নতুন সংগঠনের নাম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে আন্দোলনের পর সাত কলেজ শিক্ষার্থীরা আশ্বাস পেলেও এবার স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে বিক্ষোভ করছে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা।

সোমবার তিতুমীর কলেজের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা রাজধানীর মহাখালীতে রেলপথ অবরোধ করেছেন। এতে ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। সোমবার বিকেল ৩টা ৪০ মিনিটে মহাখালী রেল ক্রসিং অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। আগের দিন তাদের আন্দোলনের কারণে রোববারও মহাখালী, গুলশান ও এয়ারপোর্ট সড়ক অবরোধ করায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। গত শনিবার তারা বিকাল চারটার পর মহাখালী-আমতলী-গুলশান সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে ‘বারাসাত ব্যারিকেড টু নর্থ সিটি’ নামের কর্মসূচি পালন করেছে। এতে পুরো এলাকার যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। চরম ভোগান্তিতে পড়ে নগরবাসী।

অন্যদিকে, জুলাই আন্দোলনে আহতদের উন্নত চিকিৎসা, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও পুনর্বাসনের দাবিতে গত দুই দিন ধরে বিভিন্ন সড়ক অবরোধ করা হচ্ছে। শনিবার রাতে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালের সামনে সড়ক আটকে দেওয়ার পর রোববার শিশুমেলা মোড়ে অবস্থান নেয় আন্দোলনকারীরা, ফলে শ্যামলি-আগারগাঁও সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দুপুর ১২টায় চাকরিতে পুনর্বহালের দাবিতে হাইকোর্ট মাজার চত্বরে বিক্ষোভ করেছেন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্য ও তাদের পরিবার। তাদের অভিযোগ, রাজনৈতিক কারণে তারা চাকরি হারিয়েছেন।

এদিকে, বিকাল ৩টায় জুলাই হত্যাকান্ডে জড়িতদের ‘ ৎসেইফ এক্সিট’ দেওয়ার প্রতিবাদ ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে ইনকিলাব মঞ্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কযের্র সামনে থেকে মিছিল বের করে। তবে হাইকোর্ট মাজার গেটে পৌঁছালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের আটকে দেয়। এছাড়া জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনেও প্রতিদিন বিভিন্ন সংগঠনের আন্দোলন চলছে, যার ফলে তোপখানা সড়ক প্রায় প্রতিদিনই যানজটের কবলে পড়ছে।

গত ১০দিনে রাজধানীতে অন্তত ২০টি বড় ধরনের বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও ঘেরাও কর্মসূচি পালিত হয়েছে। শুধু রবিবার অন্তত পাঁচ-ছয়টি পৃথক দাবিতে আন্দোলনকারীরা রাস্তায় নেমেছেন।

এমনিতেই জনবহুল ঢাকা শহরের সড়কগুলোতে যানবাহনের গতি ধীর। তার ওপর বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে একের পর এক আন্দোলনে একরকম অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অন্তবর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সরকারি- বেসরকারি চাকরিজীবী, শিক্ষার্থীসহ নান্রা শ্রেণি- পেশার মানুষ তাদের দাবি আদায়ে লাগাতার আন্দোলন করেই যাচ্ছে। এসব দাবি আদায়ে আন্দোলনকারীরা কখনও সড়ক অবরোধ করছেন, কখনও আবার সচিবালয়সহ বিভিন্ন উপদেষ্টার কার্যালয় এসে জড়ো হচ্ছেন। এমনকি বাদ যাচ্ছে না প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনও।

উত্তরা থেকে তেজগাঁজ শিল্প এলাকায় অফিস করেন ইমরান সিদ্ধিকি। তিনি বলেন, রোববার সকালে ইজতেমার জন্য জ্যামটা অস্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু এরপর তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের একবার গুলশান এক নম্বর অবরোধ, আরেকবার মহাখালী অবরোধ। পুরো এলাকা মোটামুটি কলাপস করে। সাধারণ মানুষ অনেকে হেঁটেই রওনা দিয়েছেন। মহাখালীর জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল থেকে মাথার টিউমারের পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ শেষে সোমবার দুপুর ১টার দিকে সন্তানকে নিয়ে ফিরছিলেন তার বাবা-মা। পথে যানজটে ঘণ্টাখানেক বাসে আটকে থাকার পর বাস থেকে নেমে ছোট শিশু আসিফকে নিয়ে শ্যামলীর বাসার উদ্দেশে হাঁটতে শুরু করেন তারা। এ দম্পতির মতো সোমবারও দিনভর দুর্ভোগ পোহাতে হয় হাজারো মানুষকে। আর এই দুর্ভোগের কারণ সরকারি তিতুমীর কলেজের প্রধান ফটকের সামনে শিক্ষার্থীদের অবস্থান কর্মসূচি।

এ বিষয়ে অন্তর্বতী সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গণমাধ্যমকে বলেন, যে কেউ আন্দোলন করতে পারে, কিন্তু মানুষের চলাচল ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটি মাথায় রাখা দরকার। আর যে কোনো দাবি-দাওয়া নিয়ে হুট করে রাস্তায় নামার আগে সরকারের সঙ্গে আলোচনার দরজা খোলা রাখা উচিত।

অর্ন্ততীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর, দাবি নিয়ে রাজপথে নামে সাধারণ ও অঙ্গীভূত আনসারের সদস্যরা। এরপরই প্রশাসনের ২৫ ক্যাডার আন্দোলনে নামেন। এরপর শাহবাগ এলাকার সড়ক অবরোধ করেন প্যাডেলচালিত শত শত রিকশাচালক। এরপর হাইকোটের্র এক নির্দেশনার বিরোধিতা করে ঢাকার রাজপথে আন্দোলনে নামেন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা। বিশ্ব ইজতেমা মাঠ দখলকে কেন্দ্র করে মাওলানা যোবায়ের ও মাওলানা সাদ কান্ধলভীপন্থিদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বেতন বৃদ্ধি ও বকেয়া বেতনের দাবিতে আন্দোলন করে পোশাক শ্রমিকরা। ‘তথ্য আপা’ প্রকল্পের নারীরা আন্দোলনে নামেন। বিডিআর থেকে চাকরিচ্যূত সদস্যরা মানববন্ধন করে। শেয়ারবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় নামেন। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করা নিয়েও আন্দোলনে নামে চাকরিপ্রত্যাশীরা। সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধের দাবিতে সম্মিলিত সংখ্যালঘু জোটও আন্দোলনে নেমেছিল। এইচএসসি পরীক্ষা না দেওয়ার আন্দোলন, আবার পরীক্ষা নেওয়ার দাবিতে আন্দোলনের ঘটনাও দেখা গেছে। অটোপাসের ফলাফল বের হওয়ার পর যারা পাস করতে পারেননি, তারা নিজেদের বঞ্চিত দাবি করে আন্দোলন করেছেন। বাংলাদেশ সচিবালয় (ক্যাডারবহির্ভূত গেজেটেড কর্মকর্তা এবং নন-গেজেটেড কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা-২০২৪ মোতাবেক পদোন্নতির দাবিতে আন্দোলন করছেন। নকলনবিস, শিক্ষানবীস আইনজীবী, কনিটিটি ক্লিনিকের কর্মীরা, ইসকন,আদিবাসী ইস্যু, ইবতেদায়ী মাদ্রাসাগুলো আন্দোলনে নামে।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *