এম এইচ সৈকত
ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই বাজারে পলিথিনের ব্যাগ নিষিদ্ধের বিষয়ে সোচ্চার অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু গত বছরের অক্টোবরে সুপার শপ এবং নভেম্বরে বাজারে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে সেটা সম্ভব হয়নি। এদিকে নভেম্বরের শুরু থেকে অভিযান পরিচালনা করে জব্দ-অর্থদণ্ড করেও বাস্তবে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করা যায়নি।
তথ্যমতে, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর বিধান অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০০২ সালের ১ মার্চ পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সরকার। কিন্তু দীর্ঘ প্রায় ২২ বছরেও সেটা বাস্তবায়ন হয়নি।
এদিকে পরিবেশ রক্ষায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ৩ নভেম্বর থেকে দেশে ১৯৯টি অভিযান চালানো হয়। এসব অভিযানে ৪১৪টি প্রতিষ্ঠানকে ২৫ লাখ ৭২ হাজার ৩০০ টাকা জরিমানা এবং ৫০ হাজার ৫৫৬ কেজি পলিথিন ব্যাগ জব্দ করা হয়।
অন্যদিকে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী, দেশব্যাপী অভিযান চালালেও হাতেগোনা কয়েকটি সুপার শপের বাইরে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ দূরের কথা, কমানোও যায়নি। বাজারে কোনো প্রভাব পড়েনি এসব অভিযানের।
সরেজমিন দেখা যায়, বেশকিছু সুপার শপে আড়ালে-আবডালে ব্যবহার করা হচ্ছে পলিথিন। বিশেষজ্ঞরা জানান, শুধু আইন করে পলিথিন বন্ধ করা যাবে না। মানুষের ভেতর এ বিষয়ে চেতনা জাগ্রত করতে হবে। সেটা না হলে এটা পদক্ষেপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এ ছাড়া হুট করে কোনো কিছু বন্ধ করা যায় না। এ জন্য বিকল্প ব্যবস্থার দরকার। তাই পলিথিন বন্ধে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের তৎপরতাসহ জনসাধারণের সচেতনতা ও বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশজুড়ে রয়েছে পলিথিন ব্যাগের বিশাল এক সিন্ডিকেট। এর সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। এই সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় মন্ত্রণালয়সহ প্রশাসন। এ কারণে পলিথিন বন্ধের উদ্যোগ বিগত ২২ বছরেও সফল হয়নি। অনেক সময় অভিযান চালাতে গিয়ে কর্মকর্তারা বড় ধরনের বাধার সম্মুখীন হন।
ব্যবসায়ীরা জানান, পলিথিন ব্যাগ অবশ্যই নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। কিন্তু আগে বিকল্প দরকার। তা না হলে আমরা জিনিসপত্র কীভাবে দেব? পরে ক্রেতা এসে ফিরে যাবে, আমরাও বিক্রি করতে পারব না। এ ছাড়াও এক কেজি পলিথিন কেনা যায় ১৫০ টাকায়। এতে ২০০-২৫০ পিস পলি ব্যাগ হয়। সেখানে মাত্র ১০০ পিস কাগজের ঠোঙা কিনতে হয় ২৫০ টাকায়। পলিথিনের মতো সহজলভ্য কোনো পণ্য বাজারে নেই। একটি চটের ব্যাগের দাম পড়ে ৫০-৭০ টাকা। সেখানে ৫০-৭০ পয়সার একটি পলি ব্যাগে সমপরিমাণ পণ্য পরিবহন করা যায়।
কারখানার শ্রমিক-মালিকরা জানান, বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে কারখানা বন্ধের নির্দেশ পেটে লাথি মারার শামিল। কারখানার শ্রমিক শুধু নয়, মালিকরাও পথে বসবেন। লাখ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করা ব্যবসা, যন্ত্রপাতি কোনো কাজেই আসবে না। তাদের দাবি, পলিথিন কারখানা বন্ধের আগে শ্রমিক-মালিকদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হবে।
পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার রোধে গঠিত মনিটরিং কমিটির সভাপতি (অতিরিক্ত সচিব) তপন কুমার বিশ্বাস বলেন, পলিথিন উৎপাদন বন্ধের কার্যক্রম চলছে এবং চলবে। পলিথিন বন্ধে আমাদের দুই শতাধিক টিম কাজ করছে। এরই মধ্যে ২০০টি অভিযান চালানো হয়েছে। সেখানে জরিমানা করা হয়েছে প্রায় ২৬ লাখ টাকা।
অভিযানগুলোতে ৫০ হাজার ৫৫৬ কেজি পলিথিন জব্দ করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, পলিথিনের যেসব বিকল্প দেয়া হয়েছে, এর ব্যবহার বাড়াতে কাজ করছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়। পলিথিনের বিকল্প হিসেবে ১৫ কোটি ব্যাগ উৎপাদন করেছে সরকার। এ ছাড়া ক্রেতাদের বাড়ি থেকে ব্যাগ নিয়ে গিয়ে পণ্য কেনার অভ্যাস বাড়াতে হবে। কেননা, পলিথিন উৎপাদন বন্ধে আগামীতে অভিযান আরো কঠোর করা হবে। শুধু বাজারেই নয়, উৎপাদন পর্যায়েও আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আশা করা যায়, আগামী মার্চ থেকে এপৃল মাসের মধ্যেই পলিথিন বন্ধে সফলতা আসবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, পলিথিন ও প্লাস্টিক পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। মানবদেহের ক্ষতিসহ বিভিন্নভাবে পরিবেশ নষ্ট করে থাকে। তাই পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাট বা কাগজের তৈরি জিনিস ব্যবহার করা উচিত। কারণ, পাট বা কাগজের জিনিস মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার কারণে পরিবেশ দূষিত হয় না। কিন্তু পলিথিন পচে না, পোড়ালেও বায়ুদূষণ হয়।
তিনি আরো বলেন, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানাই। তবে মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপটি চাইলেই সহজে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। কারণ, এই পদক্ষেপের সঙ্গে আমাদের আর্থসামাজিক অনেক কিছু জড়িত। পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধে মানুষের সচেতনতা সবার আগে প্রয়োজন।