Jaijaidin

চট্টগ্রাম বন্দরের বহিঃর্নোঙরে ভাসছে রমজানের পণ্যভর্তি ২৬৯ জাহাজ

Shah Alam Soulav
7 Min Read

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি

চট্টগ্রাম বন্দরের বহিঃর্নোঙরে গত এক থেকে দেড় মাস ধরে ভাসছে রমজানের পণ্যভর্তি ২৬৯ জাহাজ। এর মধ্যে ৩৪টি মাদার ভ্যাসেল, বাকিগুলো লাইটার জাহাজ। মাদার ভ্যাসেলে লাখ লাখ টন ও লাইটার জাহাজে হাজার হাজার টন রমজানের ভোগ্যপণ্য রয়েছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, পণ্যের দাম বাড়ানোর কৌশল হিসেবে আমদানিকারকরা পণ্যগুলো খালাস না করে জাহাজগুলোকে সাগরে ভাসমান গুদাম বানিয়ে রেখেছে। এজেন্টদের দাবি, লাইটার জাহাজ সংকটে পণ্য খালাস এগোচ্ছে না। এ অবস্থায় সাগর পাড়ি দেওয়ার অযোগ্য আরো ৩৫টি লাইটার জাহাজকে প্রথমবারের মতো পণ্য খালাসে অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেশন সেল (বিডব্লিউটিসিসি)।

বিডব্লিউটিসিসির প্রধান নির্বাহী মেজর (অব.) জিএম খান সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, বিডব্লিউটিসিসির মাননীয় ডিজি মহোদয় ৩৫টি জাহাজকে বিশেষ বিবেচনায় সাময়িকভাবে বে-ক্রসিং পারমিশন দিয়েছেন। এর ফলে লাইটারেজ জাহাজের সংকট কমে আসবে।

তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের বহিঃর্নোঙরে বর্তমানে পণ্য বোঝাই ৩৪টি মাদার ভ্যাসেল অবস্থান করছে। এসব জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের জন্য এর আগে দুই শতাধিক লাইটার জাহাজ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। সবমিলিয়ে ২৬৯টি লাইটারেজ জাহাজে গত এক মাস আগে কয়েক লাখ টন পণ্য খালাস করা হলেও সেগুলো অভ্যন্তরীণ বাজারে আনা হয়নি। সবগুলো জাহাজই বিভিন্ন গন্তব্যে ভাসছে। এতগুলো জাহাজ এক মাসের বেশি সময় ধরে আটকে রাখা হলে সংকট সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক।

তিনি আরও বলেন, সংশ্লিষ্ট আমদানিকারকেরা রমজানকে সামনে রেখে দাম বাড়ার অপেক্ষায় জাহাজগুলোকে নিরাপদ গুদাম বানিয়ে আটকে রেখেছে। সচরাচর বিভিন্ন সময় গুদামে প্রশাসনের অভিযান পরিচালিত হয়, পণ্যের অবৈধ গুদামজাতকরণের জন্য জরিমানা হয়। ঝুঁকি থাকে। কিন্তু জাহাজে এসবের ঝুঁকি থাকে না। সাগরে জাহাজে কোনো অভিযান পরিচালিত না হওয়ায় আমদানিকারকেরা দাম বাড়ানোর এ কৌশল খোঁজেন বলেও অভিযোগ করা হয়।

সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরের বহিঃর্নোঙরে ৩৪টি মাদার ভ্যাসেলে কমপক্ষে দুইটি করে জাহাজ দিলেও ৭০টি জাহাজ দরকার। অথচ বিডব্লিউটিসিসির সিরিয়ালে ৪০ থেকে ৪৫টি জাহাজ রয়েছে। এতে করে সবগুলো জাহাজে চাহিদা মোতাবেক জাহাজ দেয়া সম্ভব হবে না। আমদানিকারকেরা দ্রুত লাইটার খালি না করলে পরিস্থিতির আরো অবনতি হবে। এ অবস্থায় সাগরে পাড়ি দেওয়ার অযোগ্য আরও ৩৫ লাইটার জাহাজকে পণ্য খালাসে অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালক (পরিবহণ) এনামুল করিম বলেন, লাইটারেজ জাহাজ সংকটের কারণে দেশের আমদানি বাণিজ্যের পণ্য খালাস ব্যাহত হচ্ছে। চাহিদা মোতাবেক জাহাজ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না বহু মাদার ভ্যাসেলে। এতে বহিঃর্নোঙরে জাহাজের অবস্থানকাল বেড়ে যাচ্ছে। যা দেশের সার্বিক আমদানি বাণিজ্যের জন্য ক্ষতিকর।

তিনি বলেন, সময়মতো পণ্য খালাস না করায় চট্টগ্রামে লাইটারেজ জাহাজের সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। পণ্য খালাস হওয়ার পর কিছু কিছু জাহাজ নিজেদের মতো করে পণ্য পরিবহনের জন্য লাইটারেজ জাহাজের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেশন সেল বা বিডব্লিউটিসিসির সিরিয়ালে আসে না। আবার কোনো কোনো জাহাজ মালিক ভোগ্য পণ্য পরিবহন করতে চান না। তারা খালি থাকলেও ঘোষণা না দিয়ে চুপচাপ বসে থাকেন।

অন্যদিকে মোংলা এবং পায়রাতে ভাড়া অপেক্ষাকৃত বেশি হওয়ায় অনেক জাহাজই সেদিকে চলে যায়। ভোগ্য পণ্য পরিবহনে জাহাজ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা বেশ খরচ এবং সময়সাপেক্ষ। এসব ঝামেলা এড়াতেও অনেক খালি জাহাজ ভাড়ার জন্য সিরিয়ালে আসছে না। ফলে আমদানি পণ্য খালাসে প্রয়োজনীয় জাহাজ যোগাতে সংশ্লিষ্টদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।

আমদানিকারকদের প্রতিনিধি পণ্যের এজেন্টদের পক্ষে থেকে বিডব্লিউটিসিসির বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, কিছু জাহাজ আটকে আছে কথাটি ঠিক। তবে গত ১৫-২০ দিন আগে যারা পণ্য বোঝাই করতে বরাদ্দ পেয়েছেন তাদেরকে তো জাহাজ খালি করার সময় দিতে হবে। প্রতিটি ট্রিপের জন্য তো একটি নির্দিষ্ট ফ্রি টাইম আছে। গতকাল বরাদ্দ দিয়ে আজ যদি জাহাজ খালি করতে বলা হয় তাহলে তো হবে না।

তারা বলেন, বেশ কিছু জাহাজ মালিক জাহাজ খালি করার পরও ঘোষণা না দিয়ে ভালো ভাড়ার জন্য অপেক্ষা করেন। আবার অনেকেই সিরিয়ালের বাইরে গিয়ে পণ্য পরিবহন করেন। ওই জাহাজ খালি হওয়ার তথ্যই বিডব্লিউটিসিসিকে দেয়া হয় না। প্রতিটি জাহাজের নাম ধরে ধরে খোঁজ করলে দেখা যাবে অনেক জাহাজই গন্তব্যে পণ্য খালাস করার পর কোথাও ঘাপটি মেরে বসে আছে। আবার কোনো কোনো জাহাজ মালিক বাড়তি ভাড়ার লোভে পায়রা ও মোংলা বন্দরের পণ্য পরিবহন করতে চলে গেছেন। ওই জাহাজগুলো চট্টগ্রামের সিরিয়ালেই নেই। তাই চট্টগ্রামে মাদার ভ্যাসেলের জন্য লাইটারেজ জাহাজ পাওয়া যাচ্ছে না।

ভোগ্য পণ্য পরিবহনের ব্যাপারে জাহাজ মালিক এবং নাবিকদের অনাগ্রহ এক্ষেত্রে বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করছে উল্লেখ করে একাধিক পণ্যের এজেন্ট জানান, ভোগ্য পণ্যের জন্য জাহাজ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। খাদ্য বিভাগের সার্ভেয়ার সরজমিনে পরিদর্শন করে জাহাজটি ভোগ্য পণ্য পরিবহনে উপযোগী হিসেবে রিপোর্ট দেয়ার পরই কেবল জাহাজটি পণ্য বোঝাই করতে পারে। আগের ট্রিপে পাথর কিংবা কয়লা বহনকারী অনেক জাহাজও পরিষ্কার না করে ভোগ্য পণ্য বোঝাই করতে চলে যায়।

গতকালও সাইলো জেটিতে তিনটি লাইটারেজ জাহাজ ভোগ্য পণ্য বোঝাই করতে গেলেও সেগুলো ছিল একেবারে অপরিষ্কার। খাদ্য বিভাগ জাহাজ তিনটিকেই রিজেক্ট করেছে। সংশ্লিষ্ট পণ্যের এজেন্ট নতুন করে তিনটি জাহাজ দেয়ার আবেদন করেছে। কিন্তু ওখানে তিনটি জাহাজ দেয়ার পরিস্থিতি গতকাল বিডব্লিউটিসিসির ছিল না বলেও সূত্র জানিয়েছে।

সূত্র জানায়, পুরো সেক্টরে একটি সমন্বিত শৃংখলা না আসা পর্যন্ত এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না বলেও পণ্যের এজেন্টদের কয়েকজন মন্তব্য করেছেন।
চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, রমজানকে সামনে রেখে প্রচুর ভোগ্যপণ্য আমদানি করা হয়েছে। এসব পণ্যের অধিকাংশই কন্টেনার জাহাজের মাধ্যমে বন্দরে খালাস করে রেখে দেয়া হলেও ছোলা, ডাল, ভুট্টা, গম, চিনি, সয়াবিন সিড, চনার ডালসহ নানা পণ্য খোলা অবস্থায় আমদানি করা হয়েছে। এসব পণ্য নিয়ে আসা বড় বড় মাদার ভ্যাসেলগুলো বন্দরের জেটিতে প্রবেশ করতে পারে না। এগুলো বহিঃর্নোঙরে অবস্থান নিয়ে লাইটারেজ জাহাজে পণ্য খালাস করে। এর মধ্যে কিছু কিছু জাহাজের পণ্য বিভিন্ন গন্তব্যে খালাস করা হলেও অধিকাংশ জাহাজকেই ভাসমান গুদাম বানিয়ে রাখা হয়েছে।

কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি জেসমিন সুলতানা পারুর মতে, গত কিছুদিন ধরে বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম কিছুটা কম। সে হিসেবে আমদানিকারকরা আমদানিকৃত ভোগ্য পণ্য খালাস না করে বন্দরের বহিঃর্নোঙরে জাহাজে রেখে দিয়েছে। সে কারণে বাজারে এখন সংকট তৈরী হচ্ছে। এরমধ্যে উধাও হয়ে গেছে বোতলজাত সয়াবিন। আবার বেশি দামে মিলছেও। আমদানিকারকদের কৌশলও ছিল এটাই। যাতে তারা রমজানে পণ্যের দাম বাড়াতে পারে। অসাধু আমদানিকারকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া এ সমস্যা কখনও সমাধান হবে বলে আশা করা যায় না।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *