রূপগঞ্জ প্রতিনিধি
ওরা পাঁচজন। কারো বয়স ১৫। কারো ১৬। ঐসময় তারা স্বপ্ন দেখে অন্ধকারাচ্ছন্ন কয়েকটি গ্রামে আলো জ্বালানোর। এ থেকেই তাদের পথচলা শুরু। সমাজ পরিবর্তনে এ পাচ কিশোর স্বপ্ন দেখেছিল। যুবক বয়সে সে স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। জিন্দা শুধু পার্ক নয় এটি একটি সামাজিক কাঠামো। এখানে রয়েছে স্কুল, কলেজ, মসজিদ, কমিউনিটি ক্লিনিক। এছাড়া যৌতুকবিহীন বিয়েতে সহায়তা, মাদকাসক্ত যুবকদের মুক্ত জীবনে ফিরিয়ে আনা, দূঘটনায় আহতদের চিকিৎসাসহ নানা সামাজিক মূলক কর্মকান্ডে জিন্দা পার্ক কতৃপক্ষ সহযোগিতা করে থাকে। পাশাপাশি রয়েছে প্রাকৃতিক নৈসর্গিক পার্ক। নিজ চোখে দেখলে যে কারো চোখ ছানা বড়া হয়ে যাবে। যেখানে সময় কাটালে মন হবে ফুরফুরে। পার্কটি চলে মূলত রাষ্ট্রীয় কাঠামো অনুসারে। জিন্দা এখন সারাদেশের জন্য একটি মডেল।
যাত্রা শুরু ঃ ১৯৮০ সালে রূপগঞ্জ উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নের জিন্দা গ্রামের পাচ কিশোর তবারক হোসেন কুসুম, কাজী নাসিরউদ্দিন, শাহাদৎ হোসেন খোকন, কাজী মাহবুবুল আলম বাবুল, তাবারক হোসেন এলাকার অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজ ব্যবস্থা, মানুষের দুঃখ-দূর্দশা, শিক্ষা ব্যবস্থা না থাকা, কবরস্থান না থাকাসহ বিভিন্ন সমস্যার কথা ভেবে এগিয়ে আসে। ঐসময় তারা ১৩ টাকা করে চাদা নিয়ে( মোট ৬৫ ) অগ্নিবীণা স্টুডেন্টস ফোরাম নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলে। এরপর আর তাদের পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তাদের ডাকে সাড়া দিতে থাকে এলাকার আরো অনেকে। একপর্যায়ে অগ্নিবীণা স্টুডেন্টস ফোরাম নাম বদলে হয় অগ্রপথিক পল্লী সমিতি।
গ্রাম বদলে দেয়ার গল্পঃ অগ্রপথিক পল্লী সমিতির মাধ্যমে এ পাচ কিশোর ঐসময় দাউদপুরের জিন্দা উত্তরপাড়া, জিন্দা মধ্যপাড়া, জিন্দা দক্ষিণপাড়া, কামতা মনোহরপুর, তিন ওলপ, বইলদা, ওলপ কালনী ও হিন্দু অধ্যুষিত খাইলশা গ্রামের চেহারা বদলে দেয়। এসব গ্রামগুলোতে ৮০’র দশকে ছিলনা কোন রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসা এমনকি মানুষের শেষ ঠিকানা কবরস্থানও। এরা উদ্যোগ নিয়ে গ্রামের রাস্তা ও সাকো নির্মাণ করে। এরপর স্কুল, মসজিদ, ঈদগাহ ও কবরস্থান তৈরি করে। একপর্যায়ে গ্রামের সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের সহায়তায় এগিয়ে যায় তারা। কেউ বিদেশে যেতে চাইলে, কেউ ব্যবসা করতে চাইলে কিংবা কারো চাকুরীর জন্য টাকার প্রয়োজন হলে তাদের টাকা দিয়ে সহযোগীতা করা হয়। অগ্রপথিক সমিতির সহযোগীতায় ৮ টি গ্রামসহ আশপাশের আরো অনেক গ্রামের মানুষ আজ স্বাবলম্বী। গ্রামগুলোর সমাজ ব্যবস্থা বদলে যাওয়ার পাশাপাশি বদলে গেছে মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নও। অগ্রপথিক সমিতির সহায়তায় আজ স্বাবলম্বী এমনই একজন জিন্দা উত্তরপাড়া গ্রামের আবুল হাশেম খান। তিনি বলেন, এহান থেইক্যা টেকা নিয়া ৮৮’সালে সৌদি যাই। এহন আমার উত্তরায় বাড়ী আছে, বিমান বন্দরে ব্যবসা আছে। খাইলশা গ্রামের গোপাল চন্দ্র। ২০০৫ সালে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে পোল্ট্রি ব্যবসা শুরু করেন। আজ সে স্বাবলম্বী। গোপাল চন্দ্র বলেন, একসময় নুন আনতে পান্তা ফুরাতো। এখান থেইক্যা টাকা নিয়া ব্যবসা কইরা ভালা আছি। এছাড়া যৌতুকবিহীন বিয়েতে সহায়তা, মাদকাসক্ত যুকবদের ফিরিয়ে আনতে ব্যবসার টাকা দিয়ে সহায়তাসহ নানা কাজে সহযোগীতা করে থাকে।
নৈসর্গিক পার্কঃ সামাজিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি জিন্দা এলাকায় একশ বিঘার উপড়ে জমি নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে প্রাকৃতিক নৈসর্গিক পার্ক। এ পার্কে রয়েছে লাভ লেক। এছাড়া আরো চারটি লেক রয়েছে। লেকে ঘুরে বেড়ানোর জন্য রয়েছে স্প্রিডবোর্ড। রয়েছে ৮ টি কটেজ। দুর্লভ বৃক্ষসহ প্রায় ৫’শ প্রজাতির বৃক্ষ রয়েছে। পার্কের দক্ষিণ পাশে রয়েছে একটি কৃত্রিম ঝরণাধারা। রয়েছে পিরামিড, রেষ্টুরেন্ট। পার্কের পশ্চিমপাশে রয়েছে ঝাউবন। এছাড়া স্লিপার, দোলনাতো রয়েছেই। এককথায় পার্কটি নিজ চোখে দেখলে যেকারো চোখ ছানা বড়া হয়ে যাবে। পার্কের ভেতরেই গড়ে তোলা হয়েছে স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসা, মার্কেট, ফার্নিচার দোকান, কমিউনিটি ক্লিনিক ও বঙ্গবন্ধু লাইব্রেরী। দর্শনার্থীদের সুবিধার কথা ভেবে পার্কের ৫ টি স্থানে গড়ে তোলা হয়েছে ওয়াসরুম। পিকনিক স্পট রয়েছে ৬ টি।
জিন্দা মডেলঃ জিন্দা সরকার মডেল। সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় কাঠামো অনুসারে ও সাংবিধানিক নিয়মানুসারে পার্কের কার্যক্রম চলে বলে জানা যায়। জিন্দা সরকার মডেল চলে অপস সংসদের মাধ্যমে। প্রতিসপ্তাহে একবার সংসদ বসে। অপস সংসদের স্পীকার হচ্ছেন রুস্তম আলী সিকদার। নির্বাহী প্রেসিডেন্ট শফিকুল ইসলাম, কমিশনার জাকির হোসেন, কর্মবিভাগ ব্যবস্থাপনা পরিচালক। আর প্রত্যেক সদস্য একেক জন সংসদ সদস্য। অপস সংসদের নির্দেশনা অনুযায়ী পার্ক পরিষ্কার, বাথরুম পরিষ্কার করাসহ নানা কাজ নিজেরাই করতে হয়। আর প্রত্যেক সদস্যের নামাজ পড়া বাধ্যতামূলক। যে নামাজ না পড়বে তার বেতন থেকে টাকা কেটে রাখা হবে।
দর্শনার্থীদের বক্তব্যঃ কথা হয় পার্কে আসা কয়েকজন দর্শণাথীর সঙ্গে। এদের মধ্যে একজন গৃহিনী রায়হানা সুলতানা কণা। তিনি বলেন, সত্যি পার্কটি দেখে আমি মুগ্ধ। দেশের আর কোথাও এমন প্রাকৃতিক নৈসর্গিক পার্ক আছে কিনা আমার জানা নেই। আরেক দর্শনার্থী নাসরিন আলীম বলেন, পার্কটির নান্দনিকতা যে কাউকে মুগ্ধ করবে। কোন রাইডস না থাকলেও মনখুলে ঘুরে বেড়ানোর একটি চমৎকার জায়গা।
পার্কের কর্তৃপক্ষের বক্তব্যঃ পার্কে কথা হয় পার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রতিষ্টাতা তবারক হোসেন কুসুমের সঙ্গে। তিনি বলেন, এলাকার অন্ধকারাচ্ছন্ন, কুসংস্কারচ্ছন্ন দূর করার জন্যই ৮০ সালে স্বপ্ন দেখি। রূপগঞ্জের দুর্গম এলাকা ছিল জিন্দা। এলাকার উন্নয়ন আর দুঃখী মানুষের পরিবর্তনের কথা ভেবেই এ প্রয়াস। এখনো বিয়ে করেননি কেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আরো অনেক কাজ বাকী আছে। যদি শেষ করতে পারি তাহলে বিয়ে করবো। কেন এমন উদ্যোগ নিলেন বলতেই সোজাসুজি উত্তর সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই এই উদ্যোগ