Jaijaidin

ইসলামি দল গুলোর কদর বেড়েছে

Shah Alam Soulav
9 Min Read

মিজান রহমন

রাজনীতির মাঠে নির্বাচনী উত্তাপ ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। ভোটের হিসাব-নিকাশ যত এগিয়ে আসছে বড় দলগুলোর বিরোধ ততই প্রকাশ্যে রূপ নিচ্ছে। দীর্ঘদিন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভোটের অধিকারসহ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে যারা রাজপথে শামিল ছিলেন, মাত্র ৫ মাসের মাথায় এসে তারা এখন একে অপরকে নিশানা বানাচ্ছেন। পাশাপাশি ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতিতে ইসলামি দলগুলোর কদর বেড়েছে। নিজেদের জোটের পরিধি বাড়াতে চাচ্ছে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি পাশাপাশি জামায়েতও চাচ্ছে ইসলামিদলগুলোকে কাছে পেতে। হাসিনা সরকার পতনের আন্দোলনে সঙ্গে থাকা সমমনা ‘ জোট’ ও ‘দল’-এর বাইরের ডান, বাম, মধ্যপন্থি সব সংগঠনকেই এবার সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনি ছক কষছে বিএনপি। সর্বশেষ ইসলামি রাজনৈতিক সংগঠনের প্রতি নজর তাদের। অন্যদিকে অন্যতম রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীও নানা কৌশল ও ছক আঁটছে নির্বাচন ঘিরে। মান-অভিমান ভুলে ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছে। ফলে ইসলামি দল গুলোর গুরুত্ব ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বিএনপিসহ সংশ্লিষ্ট দলগুলোর নির্ভরযোগ্য সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

অতীতে জামায়াতে ইসলামী কখনোই ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সঙ্গে রাজনৈতিক বা ধর্ম বিষয়ে কোনো আলোচনা করেনি। এবারই প্রথম জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান নিজে চলে গেছেন চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ রেজাউল করীমের সঙ্গে দেখা করতে তাঁর বরিশালের চরমোনাইয়ের বাড়িতে। দুই নেতা ব্যক্তিগত শুভেচ্ছা বিনিময় নয়, রাজনীতি করার জন্য বৈঠক করেছেন। এভাবে জামায়াতে ইসলামী আরও ছোট দলগুলোর সঙ্গেও নির্বাচনের আগে বৈঠক করবে বলে জানা গেছে। এসব বৈঠকের লক্ষ্য ছোট দলগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে নিজেদের পক্ষে আনা।

অন্যদিকে এবার ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সর্ববৃহৎ দল বিএনপি। তাদের সঙ্গে আলোচনাও শুরু করেছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। কিন্তু ছোট দলের অধিকাংশই আগামী নির্বাচনে তাদের আসন ভাগাভাগির বিষয়টি এখনই নিশ্চিত করতে চায়। এ নিয়ে বড় দলগুলো বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে ভিতরে ভিতরে তাদের আলাপ-আলোচনাও চলছে। বিএনপি দেশব্যাপী তাদের নির্বাচনি তৎপরতা চালানোর পাশাপাশি ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে ব্যাপক প্রচার শুরু করেছে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ এবং বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার নিয়ে নানা আলোচনা ও বিতর্কের মধ্যেই ইসলামী আন্দোলনের আমিরের সঙ্গে বৈঠক হলো বিএনপির মহাসচিবের। এর সপ্তাহখানেক আগে জামায়াতে ইসলামীর আমির বরিশালে গিয়ে ইসলামী আন্দোলনের আমিরের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ বৈঠক রাজনীতিতে আলোচনার সৃষ্টি করে। বৈঠকটির পর ইসলামী আন্দোলনের নেতারা ইসলামি দলগুলোর মধ্যে ঐক্য তৈরির প্রচেষ্টার কথা বলেন। এমন প্রেক্ষাপটে জামায়াতের পরে সোমবার ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে বৈঠক করল বিএনপি।

আগামী নির্বাচনকে লক্ষ্য রেখে রাজনীতিতে নানা মেরুকরণ হতে পারে বলে রাজনীতিকদেরই অনেকে বলছেন। এখনো নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় ঘোষণা করা না হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনমুখী তৎপরতা দৃশ্যমান হচ্ছে। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ইসলামি দলগুলোকে কাছে টানার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। ইসলামী আন্দোলনের আমিরের সঙ্গে বৈঠকের কয়েক দিন আগে খেলাফত মজলিসের সঙ্গেও বৈঠক করেছে বিএনপি।
ঢাকার পুরানা পল্টনে গত সোমবার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়ে চরমোনাই পীরের সঙ্গে বৈঠকে বসেন।

দীর্ঘ সময় আলোচনার পর তাঁরা ১০টি বিষয়ে একমত হওয়ার কথা সাংবাদিকদের জানান। মির্জা ফখরুল সেখানে জোহরের নামাজ পড়েন এবং চরমোনাইয়ের পীরের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন। এ সময় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা তাঁর সঙ্গে ছিলেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির দিক থেকে এ বৈঠকের লক্ষ্য, দূরত্ব কমিয়ে এনে সম্পর্কোন্নয়ন। তবে এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে মাঠে-ময়দানে বিএনপির সমালোচনা করে দেওয়া দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের বক্তব্য থামানো। বৈঠকে জামায়াতে ইসলামীর প্রসঙ্গও এসেছে।

নির্বাচনের সময় নিয়ে পুরোপুরি একমত না হলেও ইসলামি শরিয়াহবিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়াসহ ১০টি বিষয়ে একমত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে দল দুটি। বৈঠক শেষ বিএনপি ও ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের ঘোষণায় দুই দলের মধ্যে দূরত্ব কমানোর ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ‘সংস্কার ও নির্বাচন’সহ বিভিন্ন বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে যে কয়টি রাজনৈতিক দলের মতবিরোধ সামনে আসে, এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন অন্যতম। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের পতনের পর বিভিন্ন স্থানে ‘দখল, চাঁদাবাজি’ নিয়ে জামায়াতের পাশাপাশি বিএনপিকে লক্ষ্য করে বক্তব্য রেখে আসছিলেন ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম ও জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিম।

স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের এক মাসের মাথায় ফয়জুল করিম শরীয়তপুরে এক সমাবেশে অভিযোগ করেন, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর চিহ্নিত একটি দল লুটপাট, খুনখারাবি ও চাঁদাবাজি শুরু করেছে। চলতি মাসেই ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম মন্তব্য করেন, বাংলাদেশের মানুষ আর চাঁদাবাজ, দখলকারী, খুনিদের ক্ষমতায় দেখতে চায় না। সর্বশেষ ২৪ জানুয়ারি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে কর্মসূচিতে তিনি বলেন, ‘আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইসলামের পক্ষে একক বাক্স দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে।’ এ বক্তব্যগুলো বিএনপিকে নিশানা করেই বলা হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছিল।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মূলত গতকাল ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে বৈঠকের লক্ষ্য ছিল, নির্বাচনের প্রাক্কালে এ ধরনের বক্তব্যগুলো থামানো। বৈঠক শেষে দল দুটি এ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছার ঘোষণাও দিয়েছে। যৌথ বৈঠকে যে ১০ বিষয়ে ইসলামী আন্দোলন ও বিএনপি একমত হয়েছে, এর মধ্যে ৭ নম্বরে ছিল এটি। তাতে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে আঘাত করে কথা বলব না’ বলে ঘোষণা দেয় দুটি দল।

বৈঠকে উপস্থিত একটি সূত্র জানিয়েছে, আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রশ্নে ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে বিএনপি একমত হয়নি। এ ছাড়া নির্বাচনের সময় নিয়েও দল দুটিতে কিছুটা মতপার্থক্য হয়। ইসলামী আন্দোলন আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনের পক্ষে। বিএনপির নেতারা এর বিপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন, এতে আসনভিত্তিক প্রার্থী থাকবে না। ফলে মানুষ ভোটের প্রতি অনাগ্রহী হয়ে উঠবে। এ ছাড়া ভোটের সময় কেন্দ্রে ভোটার আনার একটা বিষয় থাকে। প্রার্থী না থাকলে কেউ গরজ দেখাবে না।

এ ছাড়া বিএনপি জুলাই-আগস্টের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন চেয়েছে। ইসলামী আন্দোলন প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন চায়। এ বিষয়ে যৌথ ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে চরমোনাইয়ের পীর সৈয়দ রেজাউল করীম বলেন, ‘আমরা “দ্রুত সময়” শব্দটি ব্যবহার করেছি। এবং বেশি সময় না নিয়ে যৌক্তিক, সেই যৌক্তিক সময়টা আমরা বলেছি এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে। ছয় মাস তো প্রায় চলেই গেল। আর এক বছরের মধ্যেই সুন্দর একটা জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে, এটাই মূলত আমাদের কাম্য।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পতিত ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনকারী রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরকে আক্রমণ করে দেওয়া পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের বিষয়টি আলোচনায় এলে জামায়াতের প্রসঙ্গ ওঠে। বিএনপির নেতারা বলেন, এটি চলতে থাকলে পতিত আওয়ামী লীগই এর সুবিধা পাবে। তখন ইসলামী আন্দোলনের উচ্চপর্যায়ের একজন নেতা বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীকে তো আপনারাই পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন, মন্ত্রী বানিয়েছেন।’ জবাবে বিএনপির একজন নেতা বলেন, সেটা আমাদের ভুল হয়েছে।’

এ বৈঠকে থাকা ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব বাড়ছে। আমরা জামায়াতের সঙ্গে কিছু কমন ইস্যুতে একমত হয়েছি। যেমন সংস্কার আগে, পরে নির্বাচন। আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন। এ ছাড়া আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইসলামের পক্ষে একক বাক্স দেওয়ার প্রচেষ্টাও চলছে। এমন প্রেক্ষাপটে বিএনপির মহাসচিবের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হলো। আমরা ১০টি বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে একমত হয়েছি।’

এর আগে ২১ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান বরিশালে দলীয় এক সমাবেশে গিয়ে চরমোনাইয়ের পীরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে ভিন্নমত থাকলেও দুই দলের শীর্ষ নেতাদের ওই সাক্ষাৎ বা বৈঠকের ঘটনা দেশের ধর্মভিত্তিক ইসলামপন্থীদের রাজনীতিতে কৌতূহলের সৃষ্টি করে। এর এক সপ্তাহের মাথায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম চরমোনাইয়ের পীরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে তাঁর কার্যালয়ে গেলেন।
এর আগে ২২ জানুয়ারি খেলাফত মজলিসের আমির, মহাসচিবসহ ৯ সদস্যের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির মহাসচিব ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।আরও কিছু দলের সঙ্গেও বিএনপির বৈঠক করার কথা রয়েছে।

রাজনৈতিক মহল মনে করছে, নির্বাচন সামনে রেখে ইসলামি দলগুলোকে নিয়ে জামায়াতের পাল্লা ভারী করার চেষ্টার বিপরীতে বিএনপি এ বৈঠক শুরু করেছে। যদিও খেলাফত মজলিসের সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে ধর্মভিত্তিক ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে তারা।

এ বিষয়ে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট সরকার বিদায়ের আন্দোলনে যেসব দল রাজপথে ছিল আমরা সবাইকে নিয়ে আগামীতে নির্বাচন এবং পরবর্তীতে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় সরকার গঠন করতে চাই। সে লক্ষ্যে আমরা দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ও বৈঠক করে চলেছি।’

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *