গাফফার খান চৌধুরী
প্রতিদিন গড়ে অন্তত দুই জন চালককে হত্যা করে ব্যাটারিচালিত রিকশা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। যাত্রীবেশে উঠে ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে অপরাধীরা। বাধা দিলেই চালককে হত্যা করে লাশ ফেলে দিচ্ছে নদী, নালা, খাল বিল, ডোবা বা নির্জন কোন স্থানে। যানবাহনগুলো লাইসেন্সের আওতায় আনা সম্ভব না হলে. ভবিষ্যতে আশঙ্কাজনকহারে বাড়তে পারে এ ধরণের অপরাধ। যানবাহনের লাইসেন্স না থাকার সুযোগটিকে ছিনতাইকারীরা কাজে লাগাচ্ছে বলছে পুলিশের তদন্তকারী সংস্থাগুলো।
ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ২৬ জানুয়ারি রাতে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন আফতাবনগরের চায়না প্রজেক্ট এলাকায় আব্দুস সালাম (৬৫) নামের এক চালককে হত্যার করে তার ব্যাটারিচালিত রিকশাটি ছিনিয়ে নেয় খুনীরা। তিনি শেরপুর জেলা সদরের যুগনিবাগ গ্রামের মৃত মকবুল হোসেনের ছেলে ছিলেন। মাত্র ৫ দিন আগে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। যাত্রীবেশে ওঠে নির্জন জায়গায় নিয়ে রিকশাটি ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে। এতে বাঁধা দিলে ছিনতাইকারীরা চালককে হত্যা করে গাড়িটি ছিনিয়ে নেয়।
দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, খোদ রাজধানীতেই এমন চিত্র। ঢাকার বাইরের চিত্র আরও ভয়াবহ। হরহামেশাই চালককে হত্যা করে বা ছুরিকাঘাত করে অটোরিকশা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। ছিনতাইকারীরা রীতিমত পেশাদার খুনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। অটোরিকশা ছিনতাই করতে গিয়ে অনেক ছিনতাইকারী সিরিয়াল কিলারে পরিণত হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের একটি দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। পাশাপাশি ছিনতাইকারী কাম খুনীদের পৃথক তালিকা তৈরির কাজ চলছে। সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত অপরাধ বিষয়ক সভায় বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয় ছিনতাইয়ের বিষয়টি। ছিনতাইকারীদের হাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরও খুন হওয়ার রেকর্ডও কম না। প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও দূর্ধর্ষ সব ছিনতাই, ডাকাতি বা ছিনতাই করে ব্যাটারিচালিক অটোরিকশা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। প্রতিদিন গড়ে অন্তত দুইটি করে অটোরিকশা ছিনতাই হচ্ছে চালককে হত্যা করে।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, নরসিংদীতে চালককে হত্যা করে অটোরিকশা ছিনতাইয়ের ৪৮ ঘন্টার মধ্যে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে চার জনকে।
পিবিআইয়ের নরসিংদী জেলার পুলিশ সুপার মো. এনায়েত হোসেন মান্নান জানান, গত ২১ জানুয়ারি দুপুর সোয়া ২টার দিকে চালক কাঞ্চন মিয়া তার অটোরিকশা নিয়ে বের হন। ওই দিন বাড়ি না ফেরায় তার স্ত্রী বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেন। পরদিন সকাল সাড়ে ৭টার দিকে বেলাব থানাধীন বিন্নাবাইদ বিএম কলেজ সংলগ্ন রাস্তার পাশে কাঞ্চনের লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে মনোহরদি থেকে ৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের তথ্য মতে মনোহরদির ইমরান মিয়ার গ্যারেজ থেকে অটোরিকশাটি উদ্ধার হয়।
পিবিআই সূত্রে জানা গেছে, গড়ে সারাবছরই চালককে হত্যা করে অটোরিকশা ছিনতাইয়ের অন্তত একশ’ মামলা তদন্তের জন্য থাকে। সম্প্রতি ৫৫টি মামলার রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অন্তত ২ শতাধিক জনকে। তবে অধিকাংশ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ছিনতাই হওয়া অটোরিকশা শনাক্ত বা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
তদন্তকারী সংস্থাটি বলছে, চোরাই অটোরিকশা কেনার একাধিক চক্র আছে। তারা চোরাই অটোরিকশা কিনে তার রং পরিবর্তন করে। পরে তা কোন শহরে বা শহরতলীতে বিক্রি করে দেয়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এক জেলা থেকে ছিনতাই করা অটোরিকশা দূরের কোন জেলায় বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। আকার ও রংয়ের মিল না থাকার কারণে ছিনতাই হওয়া অধিকাংশ অটোরিকশাই আর শনাক্ত করা সম্ভব হয় না।
পিবিআই সূত্রে আরও জানা গেছে, দেশের প্রতিটি জেলা উপজেলায় অটোরিকশা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। দিনকে দিন এ হার বাড়ছে আশঙ্কাজনকহারে। বেশীরভাগ অটোরিকশা ছিনতাই হচ্ছে চালককে হত্যা করে। সিএনজি ছিনতাইয়ের পর মুক্তিপণ হিসাবে মোটা অঙ্কের টাকা নেওয়ার পর ছেড়ে দিলেও অটোরিকশার ক্ষেত্রে সেটি হচ্ছে না।
পিবিআই প্রধান (চলতি দায়িত্বে) ডিআইজি মোস্তফা কামাল বলছেন, গ্রেপ্তাররা সংঘবদ্ধ চোর ও ছিনতাইকারী চক্রের সদস্য। তারা সুযোগ পেলেই অটোরিকশা চুরি করে। চুরি বা ছিনতাইয়ে বাঁধা দিলে তারা চালককে হত্যা করে অটোরিকশা ছিনিয়ে নেয়। তারা যাত্রীবেশে অটোরিকশা ভাড়া দিয়ে এভাবেই ছিনতাই করে। তারা সাধারণত কৌশলে অটোরিকশা রিজার্ভ করে। দূরে নির্জন জায়গায় নিয়ে চালককে হত্যার পর অটোরিকশা ছিনিয়ে নেয়। পরে বাহনটি চোরাই অটোরিকশা ক্রেতা বা গ্যারেজ মালিকদের কাছে বিক্রি করে দেয়। গ্যারেজ মালিকরা গাড়ির রং ও আকারগত পরিবর্তন এনে দূূরে কোথাও বিক্রি করে দেয়। এসব যানবাহনের কোন লাইসেন্স না থাকার সুযোগটিকে পুরোপুরি কাজে লাগায় ছিনতাইকারীরা।
র্যাবের আইন ও গনমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস বলছেন, অটোরিকশা চালক হত্যাকাণ্ডের অনেক মামলার রহস্য উদঘাটন করেছে র্যাব। গ্রেপ্তার করা হয়েছে খুনীদের। তারপরেও দেশের বিভিন্ন জায়গায় এ ধরণের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। অটোরিকশা ছিনতাই ও ছিনতাইকৃত গাড়িটির ক্রেতাদের গ্রেপ্তারের র্যাবের ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত আছে। পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি।
পুলিশের মূখপাত্র ও পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের সহকারি মহাপরিদর্শক ইনামুল হক সাগর বলছেন, ছিনতাই প্রতিরোধে পুলিশের তরফ থেকে ফুটপেট্রোল বাড়ানো, গোয়ন্দা নজরদারি বৃদ্ধি, ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তারে সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত আছে। বিশেষ করে চালককে হত্যা করে অটোরিকশা ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার করতে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে পুলিশের সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলোকে।