Jaijaidin

আন্তর্জাতিক নদী আইন মানছে না ইন্ডিয়া

Shah Alam Soulav
8 Min Read

আলতাব হোসেন

বছরের পর বছর ধরে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের ক্যানালের মাধ্যমে ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছে তিস্তার স্র্রোত। ধীরে ধীরে পানিশূন্য হয়েছে খরস্রোত তিস্তা। এখন মৃতপ্রায়, ধু-ধু বালুচর।

এই নদীর পাড়ে দাঁড়ালে এখন বাতাসে শোনা যায় ক্ষীণকায় তিস্তার দীর্ঘশ্বাস। ইনডিয়ার একতরফা পানি নিয়ন্ত্রণের কারণে বাংলাদেশ অংশে তিস্তার এমন দশা। এর ফলে হুমকির মুখে পড়েছে তিস্তা অববাহিকার জীবন ও জীববৈচিত্র্য। হাজারো পরিবারের উপার

ইন্ডিয়ার গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ করে ইন্ডিয়া সরকার একতরফাভাবে তিস্তার পানি নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে লালমনিরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারী জেলার ১২৫ কিলোমিটার তিস্তার অববাহিকায় জীবনযাত্রা, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। দেশের অন্যতম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজও অকার্যকর হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটির চেয়াম্যান সৈয়দ টিপু সুলতান বলেন, ইনডিয়া সরকার একতরফাভাবে তিস্তার পানি নিয়ন্ত্রণ করায় বাংলাদেশ অংশে তিস্তা এখন ধু-ধু বালুচরে পরিণত হয়েছে। একতরফা পানি প্রত্যাহার  করে আন্তর্জাতিক অভিন্ন নদী আইনের সুস্পষ্ট  লংঘন করছে ইনডিয়া।

তিনি আরো বলেন, বর্ষার সময় ইন্ডিয়া অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেয়ায় নদীর দুই পারের মানুষের জমি, ঘরবাড়ি ভেঙে তারা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন। শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে বোরোসহ অন্যান্য ফসলের চাষাবাদ ব্যাহত হয়, বিপদে পড়েন কৃষক। একসময় সরাসরি নৌকা মালবোঝাই করে পাল তুলে তিস্তা দিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেত। সেসব এখন কল্পকাহিনির মতো। নৌ-যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন এলাকার মানুষ।

আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটির চেয়াম্যান বলেন, নবায়নের সময় গঙ্গা চুক্তিতে গ্যারান্টি ক্লজ যুক্ত করতে হবে। তিস্তার পানিপ্রবাহ পুরোপুরি ভারতের মর্জির ওপর নিভর্রশীল হয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, উপমহাদেশের অন্যান্য দেশ, যেমন নেপাল ও পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সই করা পানিচুক্তিতে নিশ্চয়তা ও আরবিট্রেশন ক্লজ রয়েছে। এতে সিন্ধু ও মহাকালী পানিচুক্তি পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে করা গঙ্গার পানিচুক্তিতে শর্ত পূরণ করা হয়নি। আর এই ত্রুটির কারণে বন্ধুপ্রতিম দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আশানুরূপভাবে গড়ে ওঠেনি।

প্রসঙ্গত, ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত মোট ৪১ দিন পরীক্ষামূলকভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে পরামর্শ করে গঙ্গার ওপর ফারাক্কা বাঁধ চালু করা হয়। কিন্তু এরপর থেকে ইন্ডিয়ার একতরফা পানি প্রত্যাহার অব্যাহত থাকে এবং পরিবেশগত বিপর্যয় দেখা দেয়। পরে ১৯৭৭ সালে ৮০ শতাংশ পানি প্রাপ্যতার গ্যারান্টি ক্লজ দিয়ে পাঁচ বছরমেয়াদি পানিচুক্তি সই হয়। কিন্তু এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তা নবায়নের পরিবর্তে ১৯৮২ সালে গ্যারান্টি ক্লজ বাদ দিয়ে পাঁচ বছরমেয়াদি সমঝোতা স্মারক সই হয়। এরপর ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বণ্টনের জন্য আবারো ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তি সই হয়, যার মেয়াদ শেষ হবে ২০২৬ সালে।

নদী গবেষকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক আইনে মামলা করে সমুদ্রজয়ের মতো এবার তিস্তাজয়ের ঐতিহাসিক নজির স্থাপনে পদক্ষেপ নিতে হবে। ইন্ডিয়া আন্তর্জাতিক নদী আইন লঙ্ঘন করে একতরফাভাবে তিস্তাসহ অভিন্ন ৫৪ নদীর পানি প্রত্যাহার করছে।

নদী গবেষক ড. শহীদুল ইসলাম বলেন, তিস্তা আন্তর্জাতিক নদী হওয়া সত্ত্বেও ইনডিয়া একতরফা বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং তাদের দেশে প্রায় ছয় লাখ হেক্টর জমিতে সেচের জন্য পানি প্রত্যাহার করে নেয়ার পর বাংলাদেশের জন্য পানি ছাড়ে। সে পানি আশীর্বাদ না হয়ে বেশির ভাগ সময়ে এদেশের মানুষের জন্য বয়ে আনছে অভিশাপ। হাজার হাজার মৎস্যজীবী ও মাঝি বেকার হয়ে পথে বসেছেন। তিস্তায় পানি না থাকায় কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বর্তমানে আবার ইন্ডিয়া নতুন দুটি খাল খননসহ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র করে তিস্তার পানি প্রত্যাহারের পাঁয়তারা করছে।

তিস্তা বাঁচাও আন্দোলনের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট পলাশ কান্তি নাগ বলেন, শীতের শুরুতেই খরস্রোত তিস্তা ধু-ধু বালুচরে পরিণত হয়েছে। পানিশূন্য তিস্তায় মাছ ধরতে না পেরে জেলেরা কষ্টে আছেন। তিস্তার বৈরী আচরণে অনেক জেলে পরিবার তাদের বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে জীবন-জীবিকার তাগিদে চলে যাচ্ছেন অন্য পেশায়। প্রকৃতি হারাচ্ছে তার সৌন্দর্য।
‘তিস্তা বাঁচাও আন্দোলনে’র কর্মী অধ্যাপক আব্দুস সোবহান বলেন, ইনডিয়ার সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর নীলফামারী জেলার কালীগঞ্জ সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে তিস্তা নদী। এটি লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী বন্দর হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদীর সঙ্গে মিশেছে। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৩১৫ কিলোমিটার হলেও বাংলাদেশ অংশে রয়েছে ১২৫ কিলোমিটারের মতো। ইন্ডিয়ার উজানে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার গজলডোবায় ব্যারাজ নির্মাণ করে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করায় বাংলাদেশ অংশে ১১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা শুকিয়ে বালুচর হয়ে গেছে।

তিনি আরো বলেন, ইন্ডিয়া তিস্তা নদীর উজানে তার অংশে ব্যারাজ তৈরি করে সংযোগ খালের মাধ্যমে তিস্তার পানি মহানন্দা নদীতে, জলপাইগুড়ি জেলার দার্জিলিং, পশ্চিম দিনাজপুর ও উত্তর দিনাজপুরের মালদহ ও কোচবিহার জেলায় সেচ সুবিধা নিচ্ছে। যেখানে পানির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ আটক কিংবা পরিবর্তন করার বৈধতা আন্তর্জাতিক আইনে নেই, সেখানে ইনডিয়া আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে একতরফাভাবে তিস্তার পানির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ আটকে দিয়ে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলকে মরুকরণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যা অনৈতিক ও বাংলাদেশের মানুষের ওপর এক ধরনের অবিচার। এতে দেশের অন্যতম সেচ প্রকল্প লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার তিস্তা ব্যারাজ অকার্যকর হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তিস্তার উপর নির্মিত তিস্তা রেলসেতু, তিস্তা সড়কসেতু ও নির্মাণাধীন দ্বিতীয় তিস্তা সড়কসেতু দাঁড়িয়ে রয়েছে ধু-ধু বালুচরের ওপর। তিস্তা নদীতে মাছ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন এ অঞ্চলের জেলেরা। তারাও আজ কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এছাড়া মাঝি-মাল্লারাও কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।

নদী গবেষক আনিসুর রহমান বলেন, প্রতিবেশী দেশ ইন্ডিয়া গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ করে তিস্তার পানিপ্রবাহ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করে। এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের উপর। তারা নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে তারপর বাংলাদেশকে পানি দেয়। বর্ষাকালে ইন্ডিয়া অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেয়ায় বাংলাদেশে বন্যা হয়। পক্ষান্তরে শুষ্ক মৌসুমে চাহিদা অনুযায়ী পানি মেলে না। এভাবে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন হলেও সুফল মেলেনি এখনও। এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও জীবন-জীবিকা টিকিয়ে রাখতে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা দরকার। সেই সঙ্গে তিস্তা নদী শাসন করে জনগণের কল্যাণে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। না হলে তিস্তা পাড়ের মানুষ দেশের উন্নয়নের পথে বোঝা হয়ে থাকবে। পানিপ্রবাহ সচল ও নদী শাসন হলে তিস্তার দুই তীরে ফসলের বিপ্লব ঘটবে। এছাড়া উদ্যোগ নিলে তিস্তার পানিপ্রবাহে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

আনিসুর রহমান তিনি আরো বলেন, ইনডিয়া সরকার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দোহাই দিয়ে কালক্ষেপণ করছে। কিন্তু মমতা কার্যত পানির হিস্যা ছাড়তে নারাজ। ফলে বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও তিস্তার পানি চুক্তির সুফল দেখছি না। কখনো হবেÑ এমন সম্ভাবনাও ক্ষীণ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ।
এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে এখন পানিপ্রবাহ গড়ে প্রায় ১৫ হাজার কিউসেক। কিন্তু পানি প্রতিদিনই কমছে। একের পর এক জেগে উঠছে বালুচর। মূলত গত অক্টোবরের মাঝামাঝিতে তিস্তার পানিপ্রবাহ কমতে শুরু করে। এখন তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে পানির প্রবাহ ১৩-১৪ হাজার কিউসেকের বেশি হবে না। এভাবে কমতে থাকলে একসময় তিস্তা পানিশূন্য হয়ে যাবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডালিয়া পয়েন্টের এক উপসহকারী প্রকৌশলী বলেন, তিস্তা সেচ প্রকল্পসহ তিস্তা নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে ন্যূনতম ২০ হাজার কিউসেক পানি প্রয়োজন। তিস্তা ব্যারাজকে ঘিরে সেচ প্রকল্প চালু রাখতে হলে ২০ হাজার কিউসেক পানি দরকার।

তিস্তা পাড়ের কৃষক আব্দুল হাই বলেন, বর্ষাকালে প্রচুর পানি ছেড়ে  দেওয়ায় সৃষ্ট বন্যায় ফসলহানিসহ ঘরবাড়ি হারা হয় এ অঞ্চলের মানুষ। আবার শুষ্ক মৌসুমে ফসল রক্ষায় পানির প্রয়োজন হলেও তিস্তায় পানি দেয় না ইন্ডিয়া। ফলে শুষ্ক মৌসুমেও পানির অভাবে ফসল নষ্ট হচ্ছে তিস্তা পাড়ের। নদী শাসন ও তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা না থাকায় তিস্তা নদী এলাকার কৃষকরা বিপদে আছেন। তিস্তা এখন মৃতপ্রায়। নীলফামারী ও লালমনিরহাটের ডালিয়া ও দোয়ানীতে নির্মিত তিস্তা ব্যারাজের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে এ অঞ্চলে কৃষিজমিতে  যে সেচ দেয়ার কথা, তাও অনেকটা অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *