Jaijaidin

অন্তকোন্দলে জর্জরিত মাদ্রাসা

Shah Alam Soulav
7 Min Read

গাফফার খান চৌধুরী

অভ্যন্তরীন কোন্দল আর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি ছাড়াও নানা কারণে বহু মাদ্রাসায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ুএমন পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশী লক্ষ্য করা যাচ্ছে ঢাকায় অবস্থিত অধিকাংশ বড় মাদ্রাসায়। দূর্নীতি, পদোন্নতিতে অনিয়ম ছাড়াও নানা কারণে মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষক, মাদ্রাসা কমিটি, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের মধ্যে রীতিমত অসন্তোষ বিরাজ করছে। কোন কোন মাদ্রাসায় হামলা, ভাংচুর, লুটপাট, দখলের মত ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। এতে করে মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের অডিট ও বাজেট শাখার গঠিত অনুসন্ধান টিম কাজ করছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে যেকোন সময় অনেক মাদ্রাসায় বড় ধরণের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যেতে পারে। বিদায়ী বছরের ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সরকার পতনের পরেও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন অনেক মাদ্রাসার শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীরা। ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে মাদ্রাসাগুলোর নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের কাছে। কোন কোন মাদ্রাসার পদ পদবীসহ পুরো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নিতে রীতিমত হামলা, ভাংচুর, মামলা ও পাল্টা মামলা দায়েরের মত ঘটনাও ঘটেছে। এমন পরিস্থিতিতে রীতিমত বিব্রত মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর।
ঢাকার সিএমএম আদালত সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২৬ নভেম্বর ঢাকার সিএমএম আদালতে একটি মামলা দায়ের হয়। মামলা নম্বর ৬৪৪। মামলার বাদি মিরপুর-১ নম্বর দারুস সালাম থানাধীন হযরত শাহ আলী বাগদাদী (রহঃ)Ñ কামিল মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কে এম সাইফুল্লাহ (৫৭)।

মামলার আর্জিতে বাদি বলেন, গত বছরের আগস্টে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। এমন সুযোগে মাদ্রাসাটির শিক্ষক আফজাল হোসেন তার অনুসারী শিক্ষকদের একটি গ্রুপ ও বহিরাগত সন্ত্রাসীদের নিয়ে সংঘবদ্ধভাবে গত বছরের ৩০ অক্টোবর অধ্যক্ষের বাসভবনে হামলা চালায়। গেটের তালা ভেঙ্গে বাসভবন দখলে নেন। বাসভবন থেকে নগদ ৫০ হাজার টাকা, ১২ ভরি ওজনের স্বর্ণালঙ্কার, শাড়ি, বিছানার চাদর, ফ্রিজের মাছ- মাংস লুটের পর ফ্রিস ভাংচুরসহ অনেক কাপড় চোপড়ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে।

মামলার বলা হয়েছে, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বিষয়টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির কমিটিকে চিঠির মাধ্যমে জানান। কমিটি প্রতিষ্ঠানের সম্মান রক্ষার্থে নিজেদের মধ্যেই মীমাংসা করার উদ্যোগ নেয়। সেই লক্ষে গত বছরের ৪ নভেম্বর সালিশের মাধ্যমে মীমাংসার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বিষয়টি মীমাংসা হয়নি।

শেষ পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কে এম সাইফুল্লাহ নিরুপায় হয়ে ঢাকার সিএমএম আদালতে মামলাটি দায়ের করেন। মাদ্রাসাটির শিক্ষক আফজাল হোসেন ছাড়াও মামলায় আসামী করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক দুলাল কাজী, তৌহিদুল রহমান, আলমগীর হোসেন সুজন, মোখলেছুর রহমান, আব্দুল হালিম ও আশরাফ হোসেনসহ অজ্ঞাত ব্যক্তিদের। মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, আফজাল হোসাইনের নেতৃত্বে শিক্ষকরা বহিরাগত সন্ত্রাসীদের নিয়ে হামলা, ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনাটি ঘটিয়েছেন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে দারুস সালাম থানা পুলিশকে তদন্তের নির্দেশ দেন।

মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা দারুস সালাম থানার উপ-পুলিশ পরিদর্শক মনিরুল ইসলাম যায়যায়দিন প্রতিদিনকে বলেন, মূলত অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বাসায় হামলা, ভাংচুর ও মালামাল লুটের ঘটনাটি ঘটেছে। মামলার প্রধান আসামী আফজাল হোসেন নিজেকে মাদ্রাসাটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বলে দাবি করে আসছেন। তদন্তের ধারাবাহিকতায় আসামীদের প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র দাখিল করতে বলা হয়েছে। কিন্ত আসামীদের পক্ষে কেউ গত ৬ জানুয়ারি সোমবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত কোন কাগজপত্র দাখিল করেননি। এ ব্যাপারে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেও আশাতীত সাঁড়া মিলছে না।

তিনি আরও জানান, মাদ্রাসাটি সরকারী এমপিও ভ’ক্ত। সেখানে একজন শিক্ষক কিভাবে বা কোন প্রক্রিয়ায় জোরপূর্বক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে বছরের পর বছর ধরে দায়িত্ব পালন করে আসছেন, সেটি বোধগম্য না। এটি কোনভাবেই কোন শিক্ষক পারেন না। কারণ এমপিও ভ’ক্ত কোন প্রতিষ্ঠানে কোন শিক্ষকের জোরপূর্বক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করার আইনগতভাবে নূন্যতম কোন সুযোগই নেই।

তিনি আরও জানান, সরকার পতনের পর পরই অনেক প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, দখলসহ নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। অথচ মাদ্রাসাটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বাসভবন ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে প্রায় তিন মাস পর। এটিও একটি বড় রহস্য। অথচ আফজাল হোসেনের দাবি করছেন কে এম সাইফুল্লাহ জোরপুর্বক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের পদ দখল করে ছিলেন। তাহলে সরকার পতনের পর পরই তিনি কেন অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিলেন না বা পেলেন না, সেটিও একটি বড় রহস্যের জন্ম দিয়েছে। আশা করছি পূর্ণাঙ্গ তদন্তে পুরো বিষয়টি খোলাসা হয়ে যাবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সরকার পতনের পরেও ঢাকার অধিকাংশ মাদ্রাসায় বৈষম্য দূর হয়নি। উপরন্ত বেড়েছে। কারণ মাদ্রাসাগুলো একের পর এক বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের দখলে চলে গেছে। যেসব মাদ্রাসায় বাড়তি আয়ের উৎস আছে, সেসব মাদ্রাসায় এমন ঘটনা সবচেয়ে বেশী ঘটেছে। শাহ আলী মাদ্রাসা সংলগ্ন অন্তত শতাধিক দোকান রয়েছে। এসব দোকানের ভাড়ার টাকা ওই প্রতিষ্ঠানের একাউন্টে জমা হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একটি সুবিধাভোগী শ্রেণীর মোটা অঙ্কের সেই টাকার দিকে নজর পড়েছে। তারই সূত্রধরে মাদ্রাসাটি জোরপূর্বক দখল ও মাদ্রাসার স্বঘোষিত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দাবি করার ঘটনা ঘটতে পারে।

সূত্র বলছে, মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বঞ্চনার এখানেই শেষ না। তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রেও বৈষম্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। গত বছরের ২৭ অক্টোবর শাহ আলী মাদ্রাসার সর্বশেষ শিক্ষকদের যে পদোন্নতির তালিকা দেখা যায়, তার সঙ্গে গত বছরের নভেম্বরে প্রকাশিত তালিকার বিস্তর ফারাক আছে। অক্টোবরে প্রকাশিত তালিকায় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কে এম সাইফুল্লাহর অবস্থান ছিল ৮ নম্বরে। অথচ নভেম্বরে তার অবস্থান উপরের দিকে থাকার কথা থাকলেও, তার অবস্থান নেমে এসেছে ১০ নম্বরে। এমন অবস্থা হয়েছে এম এ করিম, আমাতুল্লাহ নূরসহ অনেক শিক্ষকের ক্ষেত্রে। এতে করে এসব শিক্ষকরা নিজেদের আত্মমর্যাদা নিয়ে চরম মানসিক পীড়ায় ভ’গছেন। জুনিয়র শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠ্য করে তাদের পদাবনতি করা নিয়ে মাদ্রাসায় রীতিমত অসন্তোষ বিরাজ করছে।

মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের একাধিক সূত্র বলছে, পতিত সরকারের ঘাপটি মেরে থাকা দোসররা পরিকল্পিতভাবে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় অরাজক ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতেই অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে এমন ঘটনা ঘটাচ্ছে কিনা, সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ব্যাপারে অধিদপ্তরের অডিট ও বাজেট শাখার গঠিত অনুসন্ধান টিম বিভিন্ন মাদ্রাসার নানা অভ্যন্তরীণ কোন্দল, স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি, মাদ্রাসার আয়ের উৎস, মাদ্রাসার কমিটি, মাদ্রাসা দখল-বেদখল, আয়-ব্যয়সহ নানা বিষয় তদন্ত করে দেখছে। তদন্তে সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এসব বিষয়ে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আব্দুল মান্নানের (অতিরিক্ত সচিব) অফিসে যোগাযোগ করা হলে অফিস থেকে জানানো হয়, মঙ্গলবারই তিনি নতুন যোগদান করেছেন। তাই এসব বিষয় সর্ম্পকে তার কিছুই জানা নেই। এসব বিষয়ে উপ-পরিচালক (প্রশাসন) মো. জাকির হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের পরমার্শ দেওয়া হয়।

জাকির হোসেন যায়য়ায়দিন প্রতিদিনকে বলেন, গত বছরের ৪ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একটি চিঠি ইস্যু করা হয়েছে। চিঠিতে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোন অধ্যক্ষ, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, শিক্ষক, কিংবা কর্মকর্তা, কর্মচারিদের জোরপূর্বক অপসারণ করা যাবে না বলে স্পষ্টভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের এমন সুষ্পষ্ট নির্দেশনার পরেও এ সংক্রান্ত অনেক অভিযোগ জমা পড়েছে। যার মধ্যে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরে জমা অভিযোগের সংখ্যাও অনেক। এসব অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে। পাশাপাশি মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরও বিষয়গুলো দেখছে।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *