Jaijaidin

অচলপত্র : হারানো দিনের নাড়ানো পত্রিকা

Shah Alam Soulav
12 Min Read

মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান

 

খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার

সাধারণত পত্রপত্রিকা সমসাময়িক ঘটনাগুলোর বিবরণ তুলে ধরে। সেই সময়ের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং শিক্ষা সবই ধরা পড়ে পত্রপত্রিকার পাতায়। কিছু কিছু পত্রিকা থাকে সময়ের চেয়ে অগ্রগামী কিংবা প্রকাশিত হয় প্রচলিত পত্রিকার ধ্যান-ধারণার বাইরের বিষয় নিয়ে। এ কারণে এ ধরনের পত্রিকা নিয়ে আলোচনার চেয়ে সমালোচনাই বেশি হয়। কিন্তু গভীরভাবে দেখলে এসব পত্রিকায় এমন অনেক উপকরণ চোখে পড়ে, যেটা হয়তো সেই সমাজের গুরুত্বপূর্ণ এবং একই সঙ্গে গোপনীয় কোনো বিষয়কে তুলে ধরে। এমন ধারার একটি পত্রিকার নাম ‘অচলপত্র’।
কলকাতায় ১৯৪৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় অচলপত্র। প্রথমে এটি মাসিক হিসেবে প্রকাশ শুরু করে। এর ক্ষুরধার বক্তব্য, উইট এবং সমাজ, সাহিত্য, শিল্পকলা, এমনকি রাজনীতি নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ পাঠকের কাছে পত্রিকাটিকে আকর্ষণীয় করে তোলে। পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি এবং গোষ্ঠীগত রোষের মুখের পড়ে অচলপত্র প্রকাশনা বেশ অনেক বছর ব্যাহত হয়। এত কিছুর পরও একপর্যায়ে সম্পাদক দীপ্তেন্দ্র কুমার সান্যাল পত্রিকাটিকে মাসিক থেকে সাপ্তাহিকে পরিণত করেন। তার ৪২ বছরের জীবনে তিনি মৃত্যু পর্যন্ত পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন। পরে তার স্ত্রী এর হাল ধরলেও সেটা বেশিদিন চালানো সম্ভব হয়নি। কেননা, পত্রিকার চরিত্র দাঁড়িয়ে গিয়েছিল মূলত সম্পাদকের ব্যক্তি-চরিত্রনির্ভর, যেটা অন্য কারো পক্ষে পূরণ করা সম্ভব হয়নি।

অচলপত্রের সমসাময়িক ‘শনিবারের চিঠি’ নিয়ে পরবর্তী সময় বিভিন্ন আলোচনা হলেও ‘অচলপত্র’ নিয়ে তেমনটি হয়নি। অচলপত্র রয়ে যায় আলোচনার বাইরে। যদিও অচলপত্র যখন বের হতো, তখন সেটা খুবই সচল ছিল। সে সময় প্রকাশিত অনেক পত্রিকা নিজেদের ‘সবচেয়ে বিক্রীত’ হিসেবে বর্ণনা করত। অচলপত্র শুরু থেকেই ভাষা নিয়ে খেলেছে। তারা নিজেদের বর্ণনা করত ‘সবচেয়ে কম বিকৃত’ পত্রিকা হিসেবে।

অচলপত্র তার বক্তব্য প্রকাশে অনেক সময় শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়ে যেত। তবে সে সময় কিছু সাহিত্য পত্রিকায় এ ধরনের আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ নতুন কোনো বিষয় ছিল না। অচলপত্র পত্রিকার সম্পাদক তার তীব্র আক্রমণের জালে সবাইকে আটকে ফেলতে চাইতেন বলে অধিকাংশই তাকে নিয়ে আলোচনা করতে চাইতেন না। একই সঙ্গে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির চক্ষুশূল হয়ে ওঠে অচলপত্র।

আক্ষরিক অর্থেই স্যাটায়ার পত্রিকার চরিত্র নিয়ে যাত্রা করে অচলপত্র। সে সময়ের প্রেক্ষাপটে একটি পত্রিকায় প্রচুর কার্টুনের ব্যবহার এবং বুদ্ধিদীপ্ত ও সরস বক্তব্য নিঃসন্দেহে ছিল সাহসী ও বিপ্লবী উদ্যোগ। সময়ের বিচারে পত্রিকার অনেক বক্তব্য এখনো সজীব হয়ে ওঠে। কেউ কেউ মনে করেন, অচলপত্র লন্ডন থেকে প্রকাশিত ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘পাঞ্চ’ দ্বারা অনুপ্রাণিত।
অচলপত্র প্রকাশের শুরুতেই এর ঘোষণা ছিল আগ্রহোদ্দীপক :
‘অচলপত্র’ নিয়মিত বেরুবার কোনো প্রতিশ্রুতি আমরা দিতে পারি না।
‘অচলপত্র’-এর জন্য কোনো কার্টুন, গল্প বা কবিতা আমন্ত্রণ করি না। বাইরে থেকে আমরা যেটা চাই, সেটা শুধু বিজ্ঞাপন।

‘অচলপত্র’ নিছক ব্যঙ্গ বা হাসির পত্রিকা নয়। এর সঙ্গে যথেষ্ট চিন্তার খোরাকও আছে। সে চিন্তা হলোÑ কী করে যথেষ্ট বিজ্ঞাপন পাওয়া যায়।
‘অচলপত্র’ আপনি যত কম ছাপা হচ্ছে ভাবছেন, সেটা নয়; শুধু তাই নয়Ñ আপনি ভাবছেন, অন্য আর পাঁচজনের মতো আমরাও বাড়িয়ে বলছি; সেটাও সত্যি নয়। আসলে আপনারা যেটা ভাবছেন, এর চেয়েও অনেক কম ছাপা হচ্ছে।

দুই

ব্যতিক্রমী নাম ও প্রকাশিত পত্রিকায় এমন বিচিত্র ঘোষণা দিয়ে শুরুতেই আলোচনায় চলে আসেন সম্পাদক দীপ্তেন্দ্র কুমার সান্যাল, যিনি নিজেকে দী. কু. সা. নামে পরিচয় দিতেন। পত্রিকার ট্যাগ লাইনটিতে ছিল সবচেয়ে বড় চমক

‘অচলপত্র : বড়দের পড়বার এবং ছেলেদের দুধ গরম করবার একমাত্র মাসিক।’

অচলপত্রের প্রথম সংখ্যায় একজন প্রখ্যাত সাহিত্যিক শুভেচ্ছা চিঠিতে পত্রিকাটিকে ‘শিশুসুলভ’ আচরণ না করে সিরিয়াস হওয়ার আহ্বান জানান। জবাবে সম্পাদক জানান, ‘রবীন্দ্রনাথের আশি বছর বয়সেও এই শিশুসুলভ প্রাণপ্রাচুর্য ছিল বলেই তিনি অত বড় হতে পেরেছিলেন। ছেলেমানুষী যেন আমাদের জীবন থেকে কখনো না ছুটি নেয়। মজে, ধ্বসে ও বুজে যাওয়া প্রাচীনদের কাছে আমরা যেন চিরকালই ছেলেমানুষই থাকি আর ‘অচলপত্র’ যেন প্রাণ-রসবঞ্চিত এই রামগরুড়ের ছানাদের দেশে অতি সিরিয়াসদের কাছে চিরদিনই অচল থাকে।’

অচলপত্রে সম্পাদক দীপ্তেন্দ্র কুমার ছাড়াও যারা লিখতেন, তাদের মধ্যে আছেনÑ শিবরাম চক্রবর্তী, বারীন্দ্রনাথ দাশ, নারায়ণ দাশ শর্মা, রমাপদ চৌধুরী, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, জ্যোতিপ্রসাদ বসু, স্বরাজ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। কার্টুন আঁকতেন প্রমথনাথ, ভাদু ভাই, শৈল চক্রবর্তীসহ আরো অনেকে।
পাঠকের মজার সব চিঠির উত্তর দেয়া হতো ‘চিঠি পত্তরের জঞ্জাল’ বিভাগে। এসব উত্তরে ভাষার খেলা ও চাতুর্য চোখে পড়ত। অর্ধশতাব্দীরও বেশি আগের প্রশ্ন ও উত্তর হলেও সেটা যে খুব অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে, সেটা হয়তো বলা যাবে না। যেমন একজন জানতে চাইলেন, ‘রাজনীতির স্রষ্টা কে?’ সংক্ষিপ্ত উত্তরে সম্পাদক জানান, Arm-chair!!

আরো কয়েকটি প্রশ্ন ও উত্তরের নমুনা দেয়া যেতে পারে,
প্র : পৃথিবীর মধ্যে কোথাকার পাগলাগারদ সবচেয়ে বড়?
উ : পৃথিবীর বৃহত্তম বাতুলালয়ের নামটি খুবই ছোট : ট. ঘ. ঙ.
প্র : বাংলা ছবিতে কী আর্ট নেই, বলতে চান?
উ : হ্যাঁ আছে, যদি আর্ট মানে হয় কলা। আর্টের নামে এভাবে কলা দেখানো বাংলা ছবি ছাড়া আর কোথায় সম্ভব, বলুন?
প্র : আমাদের বাংলা দেশের মাটির কী গুণ বলুন তো?
উ : সব মাটি করে দেয়াই এর বিশেষত্ব। যতই জোরাল কিছু এই মাটিতে গেড়ে বসার চেষ্টা করুক, দুদিনেই সেটা জোলো হয়ে হাওয়ায় উড়ে যায়। ধরুন ‘মগদের’ কথা। কী দুর্ধর্ষ এই মগÑ তাদের ভয়ে সবাই জুজুবুড়ি অথচ বাংলাদেশে এসে এই ‘মগ’ সেই যে গোসলখানায় ঢুকেছে, আর ভয়ে বেরোবার নাম নেই।
প্র : অন্যের কাছ থেকে কী পেলে আপনি খুশি হন শ্রদ্ধাজ্ঞাপন, না প্রীতিজ্ঞাপন?
উ : যেটা পেলে সবচেয়ে খুশি হই, এর নাম ‘বিজ্ঞাপন’।
প্র : নির্ভীক সাংবাদিকতা কী জিনিস?
উ : অচলপত্র।
প্র : অচলপত্রের সাফল্যের পেছনে সম্পাদক রূপে যে ব্যক্তি রয়েছেন তাকে অকুণ্ঠ অভিনন্দন জানাই।

উ : এর পেছনে কোনো ব্যক্তি নেই আছে একটি ব্যক্তিত্ব। দীপ্তেন্দ্র কুমার সান্যালই সেই অধম; যার মধ্য দিয়ে এই ব্যক্তিত্বের প্রকাশ। বাংলা সাহিত্যের আদিকাল থেকে অনাদিকাল পর্যন্ত এই ব্যক্তিত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তার আগে আর কেউ দেখা দেয়নি।

তিন

‘বঙ্কিম কটাক্ষ’ বিভাগে বিভিন্ন রকম ক্ষুরধার এবং কখনো কখনো নির্মম মন্তব্য করা হতো। থাকত বিভিন্ন রাজনৈতিক লেখা। ইনডিয়ার রাজনীতিবিদ পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু একবার বলেছিলেন, ‘চোরাকারবারিদের নিকটতম ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়ে দেয়া হবে।’

এই উক্তির কিছুদিন পর দীপ্তেন্দ্র কুমার সান্যাল লিখেছিলেন, ‘রাজনৈতিক দল এসেছে, গেছে, আসবে, যাবে, কিন্তু ল্যাম্পপোস্ট সেদিনও যেমন, আজো তেমনি আছে। এমন কী কালোবাজারিকে সবচেয়ে কাছের ল্যাম্পপোটে সরকার হাতে পেলে ঝুলিয়ে দেবেÑ এমন প্রতিশ্রুতি নেহরু একদিন দিয়েছিলেন। এরপর অবশ্য লালবাজারের কৃপায় কালোবাজার আজো অব্যাহত, আজো সবচেয়ে কাছের ল্যাম্পপোস্ট নেহরুর কাছ থেকে সবচেয়ে দূরে। …নেহরুর মুখ রক্ষার জন্যই কিনা, কে জানে, কলকাতার ফুটপাত থেকে গ্যাসের ল্যাম্পপোস্ট তুলে দিয়ে বিজলি বাতির রাজকীয় প্রবেশের প্রস্তুতি চলছে।’

আবার পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ আলি জিন্নাহকে নিয়েও তার কলম থেমে থাকেনি, ‘হার্ট ফেইলিওরে মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর মৃত্যু থেকে অনেকদিনের প্রকাশিত একটা মিথ্যা ধরা পড়ে গেল। হার্ট তাহলে ছিল তার একটা?… একটি সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে যে, মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ নিজেই টেবিল চাপড়ে বলতেন, Failure বলে কোনো জিনিস কখনো তিনি জানেন না। শুধু Heart Failure’ ছাড়া। এটা যোগ করার সময় পাননি তিনি।’

চার

ইনডিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের ডাক, সুপারি, কাগজ ইত্যাদির ওপর কর বসানোর প্রতিবাদ করে অচলপত্র প্রস্তাব করে নতুন কিছু ক্ষেত্রের নাম, যেখান থেকে সরকার ভালো কর আয় করতে পারে। এর মধ্যে কয়েকটি হলো রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্যের ওপর, দ্বারোদ্ঘাটন, ছবি বা মূর্তি উন্মোচন, বিরোধীদের ধর্মঘটের ওপর ইত্যাদি।

‘তিনটে ছটা নটায়’ ছিল মুভির সমালোচনা। দী. কু. সা নিজেই লিখতেন এই বিভাগে। সত্যজিৎ রায়ও বাদ পড়তেন না সমালোচনা থেকে। অপর্ণা সেনের বাবা চিদানন্দ দাশগুপ্ত একবার লিখেছিলেন সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’ নিয়ে।

‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক সজনীকান্ত দাস ছিলেন সে সময়ের আলোচিত সাহিত্য-সমালোচক। তার তীব্র বাক্যবাণ সহ্য করতে হয়নি এমন সাহিত্যিক কম আছেন। বলা হতো, তিনি কলম চালান না, চাবুক কষেন। আর এই সজনীকান্ত দাসই ছিলেন দীপ্তেন্দ্র কুমার সান্যালের আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্য। বিভিন্ন ছুতোয় সজনীকান্ত দাসের প্রসঙ্গ চলে আসত অচলপত্রে।

‘সাহিত্য দুঃসংবাদ’ বিভাগে একবার লেখা হলো, ‘বাংলাদেশে যত খবরের কাগজ, মাসিক, পাক্ষিক বা সাপ্তাহিক পত্রিকা আছে, সেগুলোতে যেটা বেরোয়, সবই বিদেশি পত্রিকা থেকে সবটা না হোক কিছু না কিছু চুরি। একমাত্র ঙৎরমরহধষ পত্রিকা হলো ‘শনিবারের চিঠি’। এতে যেটা বেরোয়, সবই ঙৎরমরহধষ। এমনকি ‘শনিবারের চিঠি’ নামটিও সম্পূর্ণ ঙৎরমরহধষ। বিখ্যাত বিদেশি পত্রিকা The Saturday Evening Post-এর সঙ্গে ‘শনিবারের চিঠি’ নামটির বিন্দুমাত্র সাদৃশ্য নেই।’
‘পড়বার সময় পাঁচ মিনিট’ বিভাগে ছোট ছোট প্রসঙ্গ নিয়ে আসা হতো। বিখ্যাত কবিতার প্যারোডি প্রকাশ ছিল নিয়মিত ঘটনা। পাঠকের লেখা সম্পাদকীয় এবং অচলপত্রের কঠোর সমালোচনাও পত্রিকাটি প্রকাশ করত। এ বিষয়ে সম্পাদকের সরাসরি মন্তব্য, ‘অনেকে বলছেন, আমাদের কাগজের ‘অচলপত্র’-এই অদ্ভুত নামের জন্যই এত বিক্রি হচ্ছে। আমরা যেটা জানি, সেটা নয়। নামের জন্য নয়, বদনামের জন্যই হচ্ছে। স্টলে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখুন, কেউ কাগজটাকে বলছে ‘বেশ হয়েছে’ আবার আরেকজনের মন্তব্য তৎক্ষণাৎ, ‘জঘন্য’। কিন্তু কিনছে দু’জনই। একজন কিনছে, ভালো লেগেছে বলে; আরেকজন কিনছে, ভালো লাগেনি বলে। ফল একই অবশ্য : অচলপত্রের বিক্রি বাড়ছে।’

পাঁচ

ইনডিয়া স্বাধীন হওয়ার পরপরই সেখানে রাষ্ট্রভাষা হিন্দি করার যে প্রস্তাব ওঠে, এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল বাংলাপন্থী অচলপত্র। এ সময় অনেক ধরনের লেখা অচলপত্র প্রকাশ করে। লেখার হেডিং ছিল এমন

‘আবার তোরা বাঙালি হ!’
‘জাগো বাঙালি নয়, রাগো বাঙালি!’
আলোচিত দুটো লাইন ছিল এমন :
জাগো বাঙালি রাগো বাঙালি
ভাগো অবাঙালির ভাষা হিন্দি!

অচলপত্র পাঠকদের জানায়, প্রচলিত ইংরেজি শব্দগুলোকে হিন্দিতে রূপান্তরের পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। রেলওয়ে ইঞ্জিন হয়ে যাবে ‘ভো পুকপুক’, পোস্টবক্স হয়ে যাবে ‘পত্রঘুসেট’, নেকটাই হয়ে যাবে ‘কণ্ঠিলেংগট’ ইত্যাদি।

প্রায় আট দশক আগে ‘হিন্দি হবে না’ শিরোনামে একটি লেখায় বাংলা ভাষার পক্ষে কলকাতার অচলপত্র পত্রিকার দৃঢ় অবস্থান বোঝা যায় : ‘হিন্দি কথা বলব না, হিন্দি ছবি দেখব না, হিন্দি গান শুনব না, হিন্দি শিখব না,Ñ আজকের বাঙালির রক্ত দিয়ে এই কথা লিখতে হবে, জীবন দিয়ে বলতে হবে এ কথা। এ কথা বলতে গিয়ে যদি ভারতবর্ষের মানচিত্র থেকে মুছে যেতে হয়, তবুও করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে। বিয়াল্লিশে সাহেবদের বলেছিলাম, কুইট ইন্ডিয়া। মোসাহেবদের বলব, কুইট বেঙ্গল। সংবিধান যদি বলে যে, হিন্দিই ইনডিয়ার রাষ্ট্রভাষা হবে, এটা ঠিক হয়ে গেছে, তাহলে সুরেন্দ্রনাথের প্রতিধ্বনি করে আমরা বলব Surrender not…We shall unsettle the settled fact! ! হিন্দি আর কখনই ইনডিয়ার রাষ্ট্রভাষা হবে না।’

অচলপত্র নিয়ে খুব বেশি কাজ বা গবেষণা হয়নি। জ্যোতির্ময়ী চৌধুরী পত্রিকাটির বেশ কিছু দুর্লভ লেখা, কার্টুন ও মতামত নিয়ে ‘অচলপত্র সংকলন’ সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন। হারানো দিনের সময়কে নাড়িয়ে দেয়া এই পত্রিকার নাম এখন অনেকেই জানেন না। এ বিষয়টি নিয়েও হয়তো দী. কু. সা রসিকতা করতেন। যেমন তিনি করেছিলেন অচলপত্রের দ্বিতীয় সংখ্যায়, ‘অনেকেই প্রথম সংখ্যা বাজারে দেখাই যায়নি, এই অভিযোগও করেছেন। ক্রমশ আমাদের এই সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে যে, অচলপত্রের প্রথম সংখ্যা আদৌ কোনোদিন বেরিয়েছিল কিনা।’

একই সুরে বলা চলে, অচলপত্র আদৌ কখনো বেরিয়েছিল কিনা; এ বিষয়ে গভীর সন্দেহ হয়তো এখন জন্মাতে পারত। কিন্তু সম্পাদক দীপ্তেন্দ্র কুমার সান্যাল ওয়ান ম্যান আর্মির মতো আমৃত্যু যুদ্ধ করে সে সুযোগটি আর কাউকে দিয়ে যাননি।

মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান : সাংবাদিক ও গবেষক

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *